কাজী মোতাহার রহমান
সিডর, আইলা,মহসেন, নার্গিস, বুলবুল কমবেশী আঘাত করে প্রতাপনগরের ওপর দিয়ে, গত এক যুগে। আইলার ধাক্কা সামাল দেয় এখানকার ৮ গ্রামের মানুষ। আম্পান নামক সুপার সাইকোনে অসহায় হয়ে পড়েছে ১৭ গ্রামের মানুষ। আম্পান থেমেছে ২০ দিন আগে। সহায় সম্বল হারানোর ভয়ে এখানকার ২৭ হাজার মানুষের হৃদকম্পন থামেনি। চিংড়ি ঘের ভেসেছে, ঘরে তোলা বোরো ধান ভিজেছে। কেউ আশ্রয় নিয়েছে ভাসমান ট্রলারে আবার কেউ আশ্রয় নিয়েছে রাস্তার ওপরে। বিত্তবান তেকে নি¤œবিত্ত এখন সবাই এক কাতারে।
সাতক্ষীরা জেলার মানচিত্রে পূর্ব সীমনায় সর্বশেষ ইউনিয়নটির নাম প্রতাপনগর। আবহাওয়ার সিগনাল দিলে শ্যামনগরের গাবুরা ও কয়রার দক্ষিন বেদকাশী ইউনিয়নের ন্যায় এখানকার মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। আইলায় আঘাতের পর গাবুরা বিশ^ মানচিত্রে উদাহরণ হয়ে আছে। তেমনি দক্ষিন বেদকাশী ও প্রতাপনগর এখন প্রতিদিন গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে।
আঠারোটি গ্রাম নিয়ে সাতক্ষীরার সর্বশেষ ইউনিয়নটি। ২৯হাজার মানুষের বসবাস। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডরের ধাক্কায় এখানকার সুভদ্রাকাটি, হরিষখালী ও কোলাগ্রাম ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ২০০৯ সালের ২৫ মে কপোতাক্ষের বেড়িবাঁধের ভাঙনে চাকলা, রুইয়ের বিল, সুভদ্রকাটি, চুইবাড়িয়া, দিঘলার আইট, শ্রীপুর, কুড়িকাহনিয়া ও সোনাতনকাটি গ্রামের মানুষ পানিতে ভাসে। দুই মাসেরও বেশী সময় দুর্ভোগ পোহাতে হয় এখানকার মানুষের। আইলার আঘাতে চাকলা গ্রামের মাঝখান দিয়ে একটি নতুন খালের সৃষ্টি হয়। শ্রীপুরের ৩০ ঘরের ভিটেমাটি কপোতাক্ষের গর্ভে বিলীন হয়। সোনাতনকাটির পরিত্যাক্ত জেলে পল্লীর নিশানা ছিলনা। বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে কাটাতে হয় এখানকার মানুষদের। গত ২০ মে আম্পান নামক সুপার সাইকোনের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১৬০ থেকে ১৭০ কিলোমিটার। প্রাকৃতিক এ দুর্যোগের আঘাতে কপোতাক্ষ তীরের চাকলার কোজার, শ্রীপুর লঞ্চঘাট, আবাদের কোলা, কুড়িকাহনিয়ার হবি সরদারের বাড়ি সংলগ্ন রুহুল গাজির বাড়ি, অমেদ আলীর বাড়ি, ঋষি পরিবার, সুভদ্রাকাটি মসজিদের পাশে, রুইয়ের বিল, হরিশখালীর তিনটি স্থান, খোলপেটুয়া তীরবর্তী কোলা ও গলঘেষিয়া নদীর তীরবর্তী হিজলিয়া গ্রামে ভাঙন দেখা দেয়। এসব স্থানে ভাঙনের ফলে এই ইউনিয়নের চাকলা, চুইবাড়িয়া, দিঘলার আইট, সুভদ্রাকাটি, রুইয়ের বিল, শ্রীপুর, কুড়িকাহনিয়া, প্রতাপনগর, মাদারবাড়িয়া, কল্যাণপুর, খাজরা, শিরষা, নাকনা, সোনাতনকাটি, কোলা ও হিজলিয়া গ্রামের ২৭ হাজার মানুষ পানিবন্ধি হয়ে পড়ে। শুধুমাত্র ৯ নং ওয়ার্ডের গোকুল নগর গ্রামটিতে নোনা পানি স্পর্শ করতে পারেনি। এখানকার বসতি ২ হাজার মানুষ। আম্পানের আঘাতের পর এলাকাবাসী রিংবাঁধের কাজ শুরু করে। গত শনিবার শ্রীপুর নামক স্থানে বাঁধের কাজ শেষ হয়। ৫দিনপর পূর্ণিমার জোয়ারে এলাকাবাসীর শ্রম বিফলে যায়। সকাল বিকাল জোয়ারের পানিতে ভাসছে এখানকার নারী পুরুষ। তালতলা বাজার প্লাবিত হয়েছে। মাদিয়ার পিচের রাস্তা পানির নিচে।
স্থানীয় সূত্র জানান, শ্রীপুর গ্রামের মোকলেসুর রহমান হালদার, মাকছু হালদারসহ ১০টি পরিবার গ্রাম ছেড়েছে। অনেকেই আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। কুড়িকাহনিয়া গ্রামের কয়েকটি পরিবারের ঘরে তোলা বোরো ধান নোনা পানিতে ভিজে নষ্ট হয়েছে।
প্রতাপনগর গ্রামের ব্যবসায়ী জহুরুল হক সরদার জানান, প্রতিদিন দুবার জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করলে এলাকার মানুষের সহায় সম্পদ হারানোর ভয়ে হৃদকম্পন শুরু হয়। তিনি বলেন, ৫০ বছরে এমন দুর্যোগ দেখেননি। ত্রাণ সামগ্রী অপ্রতুল বলে এলাকায় অভিযোগ উঠেছে। ৬০ বছর বয়সী নাকনা গ্রামের আদর আলী পাড় জানান, কপোতাক্ষ তীরের এমন ভাঙন গত ৫ যুগে তিনি দেখেননি। তার চৌদ্দ পুরুষের বসবাস কপোতাক্ষের তীরে। পৈত্রিক ভিটের ওপর দিয়ে জোয়ার ভাটা তিনি আগে কখনও দেখেননি।
১ নংওয়ার্ডের মেম্বর শেখ গোলাম রুসল জানান, আম্পানের ধাক্কায় গ্রামের মধ্য দিয়ে নতুন একটি খালের সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৯ সালে আইলার ধাক্কায় আরো একটি খাল সৃষ্টি হয়ে গ্রামকে দুই ভাগ করে ফেলে। আম্পানের ধাক্কায় মানুষ রাস্তার ওপর কুঁড়ে ঘর বেঁেধে মাথা গোঁজার ঠাই করে নিয়েছে। চাকলা গ্রামের শেখবাড়ি, সরদারপাড়া, ঢালী বাড়ি, গাজী বাড়ি, মিস্ত্রী ও সানা পাড়া পানির নিচে। এখানকার ৬০৯ পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল ত্রান হিসেবে দেওয়া হয়।
ইউপি চেয়ারম্যান শেখ জাকির হোসেন বলেন, ইউনিয়নের ৭ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, স্থানীয় মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে ভেঙে যাওয়া বাঁধ প্রথম দফায় মেরামত করে। পূর্ণিমার জোয়ারে তা আবার ভেঙে যায়। এখন মানুষ দিশেহারা। পানি উন্নয়ন বোর্ড কবে কাজ শুরু করবে সেই আশায় অপেক্ষা করছি।
আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মীর আলিফ রেজা এ প্রতিবেদককে জানান, এখানকার ৭টি পয়েন্ট ভেঙে ৭ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। করোনা ও আম্পানে ক্ষতিগ্রস্থ প্রতাপনগর ইউনিয়নবাসীর মধ্যে ৪৫ প্যাকেট শুকনো খাবার, ৬৫ প্যাকেট গুড়ো দুধ, নগদ ৩৯ হাজার টাকা, সাড়ে ৪ হাজার টাকার শিশু খাদ্য, ৪০ মেট্রিকটন চাল দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, পূর্ণিমা শেষে সেনাবাহিনী সংস্কার কাজ শুরু করবে। ইতোমধ্যেই তিনি কয়েকদফা ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভাগীয় প্রকৌশলী নাহিদুল ইসলাম জানান, ভাঙন কবলিত ১১টি স্থানে সোনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সংস্কার কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন, কয়েকটি বাঁধ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়নে সংস্কার কাজ হবে।