আম্ফানের তান্ডবে উঠতি বোরো ও মৌসুমি ফলের ব্যাপক ক্ষতি

8
Spread the love

বিশেষ প্রতিনিধি

ভারত ও বাংলাদেশের ওপর দিয়ে মঙ্গলবার বিকেল থেকে বুধবার রাত পর্যন্ত দ্রুত বেগে বয়ে যাওয়া প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় আমফানের তীব্র আঘাতে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন জেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে উঠতি বোরো ফসল এবং সবজি খেতসহ আম ও লিচুর। সাতক্ষীরায় আমফানের তান্ডবে ২২ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। কৃষি, মৎস্য ও পশু সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ৪শ’ কোটি টাকার। বাঁধ ভেঙ্গে রাস্তা উপচে গ্রামে পানি ঢুকেছে। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ৪ গ্রামের মানুষ। ভাঙ্গা বাঁধ মেরামতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেনাবাহিনীকে।

খুলনায় ১০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধসহ মৎস্য, কৃষি, বিদ্যুত ও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কলাপাড়ায় ছয় হাজার সবজিচাষীর সর্বনাশ হয়ে গেছে। পানিতে তাদের কয়েক কোটি টাকার ফসলহানি হয়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে সবজির লাখ লাখ চারা গাছ। যাদের বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে তাদের ঠিকানা এখন চারিপাড়া আশ্রয়কেন্দ্র। বাগেরহাটে ৪ হাজার ৬৩৫টি মাছের ঘের ভেসে গেছে। এতে কমপক্ষে দুই কোটি ৯০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমফানের প্রচন্ড আঘাতে উপড়ে পড়েছে ঐতিহাসিক যশোর রোডের ৫টি শতবর্ষী রেইনট্রি। ‘মহাদুর্যোগ রক্ষায় এতদিন যশোর রোডের শতবর্ষী গাছগুলো ঢাল হয়েছিল’। এছাড়া মঠবাড়িয়ার মাঝেরচড়ে ঘূর্ণিঝড়ে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আমফানের তান্ডবে যশোরে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১২তে উন্নীত হয়েছে। আমফানের এই আঘাতের ফলে ব্যাপকভাবে ক্ষতির অসহায় শিকার গৃহহারা হাজার হাজার মানুষের ঈদের আনন্দ এবার মাটি হয়ে গেছে! এছাড়া,মাগুরায় বিদ্যুত লাইনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ৭০ হাজার গ্রাহক অন্ধকারে রাত কাটাচ্ছে। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতার পাঠানো।

ঘূর্ণিঝড় আমফানের তান্ডব শেষ হয়েছে বুধবার রাতে। কিন্তু রেখে যাওয়া ক্ষত চিহ্ন নিয়ে এখন সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকার মানুষের দিন কাটছে অজানা আতঙ্কে। ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়েছে আধাপাকা ঘর। আর বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের পানিতে ডুবে আছে অবশিষ্ট বাড়ির অংশ। সেখানে বসবাসের সুযোগ নেই। ঘটনার দুইদিন পরও বুড়িগোয়ালিনি ইউনিয়নের দাতিনা খালি এলাকায় ভেঙ্গে যাওয়া বেড়িবাঁধের দুটি অংশ মেরামত করা সম্ভব হয়নি। বাঁধের ভেঙ্গে যাওয়া অংশ দিয়ে মালঞ্চ নদীর পানি প্রবল বেগে ঢুকছে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। বুড়িগোয়ালিনির প্রধান পাকা সড়কের প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রায় এক থেকে দেড়ফুট উচ্চতায় পানি ওভারফো করে গ্রামে ঢুকছে।

এই অবস্থা থেকে বাঁচতে দাতিনাখালি, ভামিয়াসহ আরও দুটি গ্রামের মানুষ এখন পরিবার পরিজন নিয়ে ছুটছেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়াও অনেকে চলে যাচ্ছেন আত্মীয়ের বাড়ি। শুক্রবার সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরের এই জনপদে যেয়ে দেখা যায় এই চিত্র। অনেক পরিবার স্বজনদের নিয়ে ডুবে থাকা বাড়ির সামনেই নৌকায় আশ্রয় নিয়েছেন। এদিকে আমফানের আঘাতে ভেঙ্গে যাওয়া বড় বড় বাঁধ মেরামতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোরকে। এ কাজে সেনাবাহিনী টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিবে।

পানি কমলে পানি উন্নয়ন বোর্ড স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করে সমন্বয়ের মাধ্যমে এই বাঁধ টেকসই হিসাবে নির্মাণ করা হবে। খুলনা বিভাগীয় কমিশনার ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার শুক্রবার দুপুরে ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরার শ্যামনগরের সুন্দরবন সংলগ্ন বুড়িগোয়ালিনি এলাকা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান। আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের শ্যামনগর, কয়রা ও শরণখোলা এলাকার ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধগুলো মেরামতের জন্য সেনাবাহিনীকে মন্ত্রণালয় থেকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত গৃহহীনদের পুনর্বাসন চলবে তালিকা প্রস্তুত ও বাছাইয়ের পর। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ক্ষতিগ্রস্ত কেউ বঞ্চিত হবে না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, করোনার কারণে যে খাদ্য সহযোগিতা চলছে তা অব্যাহত থাকবে। এ সময় সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এম এম মোস্তফা কামাল, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে ঘূর্ণিঝড় আমফানের তান্ডবে সাতক্ষীরায় ২২ হাজার ৭১৫টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ও প্রায় ৬১ হাজার ঘরবাড়ি আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। কৃষি, মৎস্য ও পশু সম্পদ বিভাগ মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এছাড়া কৃষিবিভাগের যে ক্ষতি হয়েছে তাতে টাকার পরিমাণ ১৩৭ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। মৎস্য বিভাগের ক্ষতি হয়েছে ১৭৬ কোটি ৩ লাখ টাকা। প্রাণিসম্পদের ৭৭ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। ৮১ কিলোমিটার রাস্তা ও ৫৭.৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া দেড় শতাধিক বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়েছে। গাছপালা ভেঙ্গে পড়েছে অসংখ্য। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

আমফানের তান্ডবে এবং জলোচ্ছ্ব্াসে প্রায় ১০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে গেছে প্রায় ১০ কিলোমিটার এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ১০০ কিলোমিটার বাঁধ। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৪ লাখ মানুষ।

সম্পূর্ণ ও আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় ৮২ হাজার ঘরবাড়ি। প্রায় ২ লাখ গাছপালা ভেঙ্গে গেছে ও উপড়ে পড়েছে। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ফসলি জমির। শত শত পুকুর ও মাছের ঘের ভেসে গেছে। বেড়িবাঁধ, মৎস্য, কৃষি, বন, বিদ্যুত ও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা সার্বিক ক্ষতি নিরূপণে কাজ করছেন। প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী খুলনার ৬৮ ইউনিয়নেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা উপজেলায় বেশি ক্ষতি হয়েছে। জেলায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৪ লাখ মানুষ। ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় ৮২ হাজার। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে জেলার সুন্দবরন সংলগ্ন কয়রা উপজেলায়। এই উপজেলায় বেড়িবাঁধের প্রায় ১০-১২টি স্থান ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। শুক্রবার সকালে স্থানীয় জনগণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধ আটকানোর কাজ শুরু করে। খুলনা-৬ আসনের সংসদ (কয়রা-পাইকগাছা) সদস্য মোঃ আক্তারুজ্জামান বাবু জানান, কয়রা উপজেলা ১২১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে প্রায় ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকার মাছের ক্ষতি হয়েছে।

কয়েক হাজার হেক্টর মৎস্য ঘেরের ক্ষতি হয়েছে। অন্তত ১৫ হাজার বাড়ি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, খুলনায় ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১০ কিলোমিটার সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে, এগুলো সবই কয়রা উপজেলায়। এছাড়াও দাকোপ, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা ও ডুমুরিয়া উপজেলায় আংশিক ক্ষতি হয়েছে অন্তত ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। এছাড়াও কয়রা উপজেলার ভেঙ্গে যাওয়া বেড়িবাঁধের মধ্যে দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের ছোটো আংটিহারা বাকেরগাজীর বাড়ির পাশে শাকবাড়িয়া নদীর প্রায় ১২০ গজ বেড়িবাঁধ, আংটিহারা মজিদ গাজীর পাশে ৩০০ গজ বেড়িবাঁধ, জোড়শিং বাজারের পাশে ৫০০ গজ বেড়িবাঁধ, কপোতাক্ষ নদের চোরামুখা খেয়াঘাটের কাছে ৫০০ গজ বেড়িবাঁধ ও গোলখালী তসলিম মোল্লার বাড়ির পাশে ৫০০ গজ বেড়িবাঁধ, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের গাজীপাড়া গ্রামের মাথায় কপোতাক্ষ নদের ৬০০ গজ বেড়িবাঁধ, কাটকাটা বাজারের শাকবাড়ীয়া নদীর ৩০০ গজ বেড়িবাঁধ, মহারাজপুর ইউনিয়নের দশালিয়া গ্রামে কপোতাক্ষ নদের ৭০০ গজ বেড়িবাঁধ এবং কয়রা সদর ইউনিয়নের হরিণখোলা ও গোবরা ঘাটাখালি গ্রামে কপোতাক্ষ নদের আধা কিলোমিটার এলাকাসহ ১০টি জায়গার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে এবং মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের কয়রা নদীর পানি পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধ উপচে লবণ পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। ঐতিহাসিক যশোর রোডের ৫টি শতবর্ষী রেইনট্রি গাছ উপড়ে পড়েছে এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় আমফানের তান্ডবে। আর কিছু কিছু গাছের ডালপালা ভেঙ্গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রোডের দুই সহস্রাধিক রেইনট্রি গাছ মহাদুর্যোগ রক্ষায় ঢাল হয়ে বেশ ভূমিকা রেখেছে। মানুষ রক্ষা করতে গিয়ে এক রাতেই প্রাণ দিল ৫টি বৃক্ষ। যশোর জেলা পরিষদের হিসাবে বুধবার রাতে ঘূর্ণিঝড় আমফানের তান্ডবে যশোর রোডের যশোর-বেনাপোল ৩৮ কিলোমিটার অংশে ৫টি শতবর্ষী রেইনট্রি গাছ উপড়ে পড়েছে রাস্তায়। এছাড়া সুপার সাইকোন ‘আমফান’র তান্ডবে সুন্দরবন সন্নিহিত উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকেরা হাঁসফাস করছেন। ‘আমফানের’ ছোবলে জেলার প্রায় ৫ হাজার চিংড়ি ঘের ও পুকুর ভেসে গেছে।

মাঠে থাকা সবজি, আমনের বীজতলা, পাকা ধানসহ ১৭শ’ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এতে কৃষকদের কমপক্ষে সাড়ে ৬ কোটি ৪০ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। বাগেরহাটে ৪ হাজার ৬৮৬টি কাঁচাঘর বিধ্বস্থ হয়েছে। বিধ্বস্থ ঘরগুলোর মধ্যে চার হাজার ৩৩৯টি ঘর আংশিক এবং ৩৪৭টি ঘর সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। জেলার শরণখোলা, মোংলা, রামপাল ও সদর উপজেলার নদী সংলগ্ন ৮ স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ১২ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বৃহস্পতিবারও জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় এসব এলাকায় মানবেতর অবস্থার সৃষ্টি হয়।

এঅবস্থায় ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা তৈরী করে পুণর্বাসন কার্যক্রম শুরু করেছে প্রশাসন। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা খালেদ কনক বলেন,জলোচ্ছ্বাসে বাগেরহাটে ৪ হাজার ৬৩৫টি মাছের ঘের ভেসে গেছে। এতে কমপক্ষে দুই কোটি ৯০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। বাগেরহাটে ৭৮ হাজার ১’শ মাছের ঘের রয়েছে।’ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ দফতরের উপ-পরিচালক রঘুনাথ কর বলেন, জলোচ্ছ্বাস ও অতিবর্ষণে মাঠের গ্রীষ্মকালীন সবজি ও আউশ ধানের বেশি ক্ষতি হয়েছে। কমপক্ষে সাড়ে ৬ কোটি ৪০ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।