বিশেষ প্রতিনিধি:
অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে সাত জনের প্রাণহানির সংবাদ নিশ্চিত করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। সার্বিক ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে মাঠে কাজ করছে মাঠপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা। প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্যে ১৯ জেলায় ক্ষয়ক্ষতির কথা জানা গেছে। বৃহস্পতিবার (২১ মে) বিকাল ৪টা নাগাদ পাওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সচিবালয়ে বসবে আন্তমন্ত্রণালয় সভা। বিকাল ৫টায় প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক বিবরণসহ সরকারের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম তুলে ধরা হবে।
একই সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পরিকল্পনা ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন বিষয়ে সরকারের উদ্যোগসমূহ প্রেস ব্রিফিংয়ে জানানো হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এবারের ঘূর্ণিঝড় আম্পানে দেশের চার জেলায় সাত জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এরমধ্যে ভোলায় দুই জন, পটুয়াখালীতে দুই জন, সন্দ্বীপে এক জন ও যশোরের চৌগাছায় দুই জন। নিহত সাত জনের মধ্যে ছয় জনই মারা গেছেন আম কুড়াতে গিয়ে। অপর একজনের প্রাণ গেছে দেয়াল ধসে। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান।
অপরদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্র জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে সাত জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এদের মধ্যে পটুয়াখালীর কলাপাড়া ও গলাচিপায় দুই জন, ভোলার চরফ্যাশন ও বোরহানউদ্দিনে দুই জন, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় একজন, সাতক্ষীরা সদরে একজন ও সন্দ্বীপে একজন।
সূত্র জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশের ১৯ জেলা কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বেশি ক্ষতি হয়েছে সাতক্ষীরা, খুলনা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলায়। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে এসব এলাকার অনেক বাঁধ ভেঙে গ্রাম ইউনিয়ন তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে ঘেরের মাছ। লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। ঘরবাড়ির চাল উড়ে গেছে। কাঁচা ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। স্কুলের দেয়াল ধসে গেছে, চাল উড়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানিয়েছেন, ‘এ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন ঘটনায় সাত জনের প্রাণহানির সংবাদ পেয়েছি। আমরা ঘূর্ণিঝড়ে সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে কাজ করছি। তথ্য সংগ্রহ করছি। এ জন্য জেলা প্রশাসকদের নেতৃত্বে জনপ্রতিনিধিসহ সরকারি কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন। বিকাল ৪টা নাগাদ একটা ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক ধারণা পাবো। চূড়ান্ত হিসাব পেতে হয়তো ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগবে। তবে ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক হিসাব নিয়েই বিকালে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রতিনিধি, মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ আন্তমন্ত্রণালয় সভা করবো। এই সভায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচিসহ ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ করা হবে।’
এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শাহ কামাল জানিয়েছেন, ‘আমরা বুধবার সারা রাত কাজ করেছি মানুষের প্রাণহানি ঠেকানোর জন্য। আল্লাহর অসীম রহমতে আমরা এ কাজটি করতে পেরেছি। তার পরেও বিচ্ছিন্ন ঘটনায় দুঃখজনকভাবে কয়জন মানুষ মারা গেছেন। তবে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি বলে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত। আমাদের কর্মকর্তা কর্মচারীরা কাজ করেছেন। সকাল থেকে তারা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে মাঠে কাজ করছেন। তারা ফিরে না আসা পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ বলা কঠিন। বিকাল নাগাদ আমরা প্রাথমিক হিসাব পাবো।‘
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরাজানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব জিয়াউল হাসান জানিয়েছেন, ‘ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডব এবারও সুন্দরবনের ওপর দিয়ে গেছে। বিশাল সীমানার সুন্দরবনের ক্ষতি তো হয়েছেই। তবে তা নিরূপণ তো সহজ কাজ নয়। বিশাল এই সুন্দরবনে গাছগাছালিসহ বিভিন্ন প্রাণীও রয়েছে। তাই এখন পর্যন্ত বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ পাইনি। তবে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে মাঠে রয়েছে বন বিভাগের কর্মকর্তারা। অনেক এলাকার টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে বলে জেনেছি।‘
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ জানিয়েছেন, ‘আমরা মাঠে আছি, আমাদের ৪২টি টিম আগে থেকেই মানুষের জনমাল রক্ষায় ৪২টি ইউনিয়নে কাজ করছে। তারাই ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজে রয়েছে। প্রাথমিক হিসাব পেতেও কয়েক ঘণ্টা সময় দিতে হবে। বিকাল নাগাদ একটা হিসাব মন্ত্রণালয়ে পাঠাবো।’
পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মতিউল ইসলাম চৌধুরী জানিয়েছেন, জেলায় বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে রাঙ্গাবালী, গলাচিপা উপজেলায়। সেখানকার ফসলি জমিতে লোনা পানি প্রবেশ করেছে। আমরা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করছি।
এদিকে খুলনার জেলা প্রশাসক হেলাল হোসেন জানিয়েছেন, আম্পান মূলত সুন্দরবনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে, এজন্য সুন্দরবনের ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও পাইকগাছা, কয়রা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় লবণাক্ত পানি ঢুকে ফসলি জমির ক্ষতি করেছে। বাঁধ ভেঙে গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। মাঠের ধান আগেভাগেই কাটা হয়ে গেছে। তাই ধানের ক্ষতি তেমন হয়নি। তবে মাছের ঘেরের চিংড়ির ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। পানির প্রবাহে এলাকার বেশিরভাগ ঘেরের চিংড়ি মাছ ভেসে গেছে। এতে খামারিরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
উল্লেখ্য, আম্পানের প্রভাবে ঝড় ও জোয়ারে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ১৬ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছেন প্রতিনিধিরা। এরমধ্যে যশোরে গাছ চাপা পড়ে ছয় জন নিহত হয়েছেন। পটুয়াখালীতে ঝড়ে গাছ চাপা পড়ে ও মানুষকে সচেতন করতে গিয়ে নৌকাডুবিতে দুই জন মারা গেছেন। ভোলায় গাছচাপা পড়ে ও ট্রলার ডুবে দুই জন মারা গেছেন। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় দেয়াল চাপা পড়ে মারা গেছেন আরেক ব্যক্তি। আর সাতক্ষীরা সদরে আম কুড়াতে গিয়ে গাছচাপায় তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। চাঁদপুরে গাছ চাপা পড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে।