আনোয়ার হোসেন, মণিরামপুর (যশোর)
দুই সন্তানসহ কুলসুম বেগমকে ফেলে স্বামী ইয়াসিন হোসেন উধাও হয়েছেন ৮-১০ বছর আগে। অল্প বয়স হলেও নতুন সংসার না পেতে স্কুলগামী সন্তানদের বুকে নিয়ে পড়ে আছেন বাপের ভিটেয়। রাস্তায় কাজ করে, বেকারিতে রান্না করে এমনকি অন্যের বাড়িতে কাজ করে অনেক কষ্টে দিন যায় কুলসুমের। উপরন্তু দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ। করোনা ভাইরাসের কারণে গত দুইমাস সবধরণের কাজ বন্ধ কুলসুম বেগমের। মানুষের এই দুর্দশার মধ্যে সরকার কত লোককে খাদ্যসহায়তা দিয়েছেন কিন্তু কোন প্রকার সহযোগিতা পাননি কুলসুম বেগম।
একই বাড়িতে বসবাস কুলসুম বেগমের ছোট ভাই জাহাঙ্গীর আলোমের। বেকারির পণ্য ফেরি করে বৃদ্ধা মা ও স্ত্রী সন্তান নিয়ে কোন প্রকার কেটে যাচ্ছিল তারও। করোনায় সেও গৃহবন্দি। সরকারি ত্রাণের জন্য জাহাঙ্গীর নেতাদের পিছে হেঁটেও একমুঠো চাল আনতে পারেননি।
একই গ্রামের ইমরান হোসেন মোটরসাইকেল ভাড়ায় চালিয়ে সংসার চালায়। বৃদ্ধা দাদি এটাওটা করে ইমরানের সাথেই থাকেন। ত্রাণ জোটেনি তাদেরও। ইমরানের পাশের বাড়ির বাসিন্দা নূর হোসেন ছুট্টি। দিন এনে দিন খাওয়া তার। স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে কর্মহীন করোনা পরিস্থিতি মুকাবেলা করলেও সমাজপতিদের কেউ এগিয়ে আসেনি একমুঠো ত্রাণ নিয়ে। নূর হোসেনের পাশেই বাড়ি বিধবা আনোয়ারার। স্বামী ইব্রাহীম পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন। অল্প বয়সী দুই ছেলেকে নিয়ে কষ্টের সাগর পাড়ি দিচ্ছেন তিনি।
এরা সবাই যশোরের মণিরামপুর উপজেলার মাহমুদকাটি গ্রামের বাসিন্দা। ভিজিডি বা ফেয়ারপ্রাইজ এমনকি সরকারি কোন সহায়তায় নাম নেই এদের। তাদের অভিযোগ ৪-৫ বার করে ভোটার কার্ডের ফটোকপি নিয়েছে নেতারা। কিছুইতো পাইনি।
খেদাপাড়া ইউপির সাত নম্বর (মাহমুদকাটি-কদমবাড়িয়া) ওয়ার্ডের কদমবাড়িয়া গ্রামের নি:স্ব ও অসহায় স্বামীহারা জামেলা, জাহানারা ও নূরজাহান বেগম। এদের সংসার দেখার কেউ নেই। আবার সমাজের জনপ্রতিনিধি বা নেতারাও এদের দিকে ফেরেন না।
কুলসুম ও জাহানারাদের মত এমন বহুপরিবার মাহমুদকাটি-কদমবাড়িয়া গ্রামে রয়েছেন; যাদের খবর কখনো রাখেন না কেউ। সরকারি ত্রাণ বা কোন সহযোগিতা আসলে যাদের উপর তালিকার দায়িত্ব পড়ে তারাই নিজেদের বা পরিবারের অন্য নাম দিয়ে সেটা আত্মসাৎ করেন।
করোনা পরিস্থিতিতে ঈদ উপলক্ষে গৃহবন্দি কর্মহীন, দুস্থ ও অসহায় মানুষের জন্য নগদ অর্থ ও চাল দিতে যাচ্ছে সরকার। পরবর্তীতে মাসিক ২০ কেজি করে চাল পেতে পারেন এরা। সেইলক্ষে মণিরামপুরে ১২ হাজার লোকের তালিকা হচ্ছে। তারমধ্যে খেদাপাড়া ইউপির সাত নম্বর ওয়ার্ডে ৭৯ জনের তালিকা জমা হয়েছে। তালিকা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ওই ওয়ার্ডের মেম্বর তায়জুল ইসলাম নিজের ছেলের নাম দিয়েছেন। শুধু মেম্বর না তালিকা প্রস্তুতির কাজে যারাই ছিলেন তারাই নিজের বা পরিবারের নাম দিয়ে রেখেছেন। যারা এই তালিকাভুক্ত হওয়ার যোগ্য নয়।
ওই ওয়ার্ড আ’লীগের সভাপতি জিএম মশিউর রহমান মুকুল তার পরিবারের সচ্ছল চার জনের নাম দিয়েছেন। যারা শিক্ষক দম্পতি ও প্রবাসীর স্ত্রী। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর সরকারি সহায়তার তালিকায় স্বজনপ্রীতির অভিযোগে মুকুলকে দলীয়ভাবে শোকজ করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে তার কাছে জবাব চাওয়া হয়েছে। একই সাথে ওয়ার্ডের ত্রাণ সংক্রান্ত সকল দায়িত্ব থেকে তাকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে বলে জানান খেদাপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-আহবায়ক আব্দুল আলীম জিন্নাহ।
এদিকে মাহমুদকাটি-কদমবাড়িয়া ওয়ার্ডের মানবিক সহায়তার ৭৯ জনের তালিকার মধ্যে সচ্ছল ও অযোগ্য নয় জনের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। সেখানে কুলসুম, জামেলা, জাহানারা ও নুর জাহানসহ নয় জনের নাম যুক্ত করা হয়েছে। তারপরও বাদ দেওয়ারমত তালিকায় আরো সচ্ছল নাম রয়েছে।
অভিযোগ করা হচ্ছে, মণিরামপুরে প্রস্তুতকৃত মানবিক সহায়তার ১২ হাজার তালিকার মধ্যে বহু সচ্ছল ও অযোগ্য নাম রয়েছে। বিষয়টিতে ইউএনওর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন এলাকাবাসী।
জানতে চাইলে খেদাপাড়া ইউপির সাত নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য তায়জুল ইসলাম মিলন বলেন, আমি গরিব মানুষ; তাই ছেলের নাম তালিকায় দিয়েছি।
খেদাপাড়া ইউপি সচিব মৃনাল কান্তি বলেন, ইতিমধ্যে অভিযোগ তদন্ত করে সাত নম্বর ওয়ার্ডে নয়টি নাম সংশোধন করে নতুন নাম যুক্ত করা হয়েছে। যত অভিযোগ আসবে সেগুলো তদন্ত সাপেক্ষে বাদ দেওয়া হবে।
মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান উল্লাহ শরিফী বলেন, মেম্বরের ছেলের নাম তালিকায় দেওয়ার সুযোগ নেই। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া কোথাও কোন অভিযোগ আসলে সেগুলো তদন্তসাপেক্ষে বাদ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সচিবদের নির্দেশনা দেওয়া আছে।