আলী ইব্রাহিম
চীনের হুবেই প্রদেশে উহান যা গণচীন নামে পরিচিত। সেখানকার সীফুড মার্কেট থেকে উৎপত্তি কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস। যদিও বিশ্ব রাজনীতিতে এই উৎপত্তি নিয়ে নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত আড়াই লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণ সংহার হয়েছে, কিন্তু আজো কোন সুরাহা হয়নি এই বিষয়ের। বিশ্ব মোড়লরা একে অপরকে দোষারোপ করছেন কিন্তু সফলতা কারো নেই। বিজ্ঞানীরা দিন-রাত এক করে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। চলছে ভ্যাকসিন আবিস্কারের নানা প্রচেষ্টা। ১০৮ টিরও বেশি ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ চলছে সারা বিশ্বে। সফলতা বলতে এখন পর্যন্ত মনের শান্তনা বেশি করে ভিটামিন সি, পুস্টিকর খাবার গ্রহন করুন আর রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ান। স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলুন। আর করোনা প্রতিরোধে বিশ্বের প্রতিটি দেশ লকডাউন চলছে। থমকে গেছে অর্থনীতি। জীবিকা নয়, জীবনে তাগিদে লড়ছে মানুষ।
১. এবার আসি দেশের প্রসঙ্গে। করোনারোগী দেশে প্রথম শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। শুরুর দিকে তিন জন হলেও সেই থেকে শুরু। আজ দুই মাসে করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছে ১৩ হাজারেরও বেশি। যদিও আমাদের করোনা পরীক্ষার সক্ষমতা নিয়ে নানা সীমাবদ্ধতা ছিল। এখন অবশ্যই পরিধি বাড়ছে। এখন প্রায় প্রতিদিনই পাঁচ থেকে ৬ হাজারেরও বেশি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এসব পরীক্ষায় গত কয়েকদিন ধরে সাড়ে ৬শ থেকে সাড়ে ৭শর বেশি রোগী প্রতিদিনই শনাক্ত হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রায় ১৬ কোটি মানুষের জনবহুল দেশে এই পরীক্ষা পর্যাপ্ত নয়। লকডাউন করে যারা সফলতা পেয়েছে তাদের তুলনায় আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ যেন ক্ষুদ্র এক প্রয়াস মাত্র।
২. করোনা প্রতিরোধে গত ২৬ মার্চ থেকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। ধাপে ধাপে এই ছুটি বেড়ে সর্বশেষ ১৬ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। উদ্দ্যেশ্য একটাই মানুষকে করোনার হাত থেকে রক্ষা করা। কার্যকর লকডাউন না বলে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর পরই আমরা দেখেছি ঘরমুখী মানুষের ঢল। রাজধানী থেকে নানা উপায়ে মানুষ বাড়ি ফিরছেন। কারণ এই ছুটিতে তারা এই শহরে অসহায়। হয়তবা দুবেলা তাদের অন্নের যোগান দিতে কষ্ট হবে। তাই তো তারা ফিরেছেন নিজ মাটিতে যেখান থেকে তারা জীবিকার তাগিদে এই নগরীতে এসেছিলেন।
৩. টানা অঘোষিত লকডাউনে ঘরে বসতে বসতে এক ধরণের মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। ডাক্তাররা স্বাস্থ্য সুরক্ষার নানা টিপস দিচ্ছেন। সবাইতো বাঁচতে চায়। ঘরে খাবার থাকার পরও হয়ত কিছু মানুষ বের হতে পারে। কিন্তু শতকরা প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ঘর থেকে বের হন জীবিকার তাগিদে। করোনা থেকে যদি বেঁচে যান, তাহলে ক্ষুধা মেটাবেন কিভাবে? দেশের উবার-পাঠাও চালক, হোটেল-রেস্টুরেন্ট শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, দোকান-কর্মচারি সব মিলে অনানুষ্টানিক খাতে প্রায় ৪ কোটি মানুষ কাজ করছেন। তাদের জীবন কিভাবে চলবে? আর যতটুকু সহায়তা পাচ্ছেন তা কি যথেষ্ট? আর যারা এই ত্রাণের সুযোগ নিচ্ছেন তাদের কথা নাই বা বললাম।
৪. আমরা এলডিসি উত্তরণ করে সবেমাত্র মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় সংযুক্ত হয়েছি। এমন দেশে কোটি কোটি শ্রমিকের খাদ্য সহায়তা কতটা চ্যালেঞ্জিং যারা সরকারের নীতি-নির্ধারণী র সঙ্গে যুক্ত তারা ভালো বলতে পারবেন। তবুও সরকার তাদের সহায়তা দিচ্ছে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। যদিও এই প্রণোদনা স্বল্প সুদের ঋণ। ব্যবসায়ীদের দাবি আর অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সীমিত পরিসরে খুলে দেয়া হয়েছে রপ্তামুখী শিল্প কারখানা। নতুবা বিদেশি অর্ডার আমাদের থাকবে না অন্য দেশে চলে যাবে। আমরা রপ্তানিতে পিছিয়ে যাব। কিন্তু যেসব শর্ত জুড়ে কারখানা খুলে দেয়া হয়েছে, সেসব শর্ত কি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে?
৫. সারা পৃথিবী আজ থমকে আছে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সব স্থবির। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের এক তৃতীয়াংশ পরিবার প্রবাসী আয়ের সঙ্গে যুক্ত। এই অবস্থায় প্রবাসী শ্রমিকরা করোনা মহামারিতে কর্মসংস্থান হারাচ্ছেন। দেশে অর্থ পাঠানোর সক্ষমতা কমতে শুরু হয়েছে। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের এপ্রিল মাসের টাকা পাঠানোর চিত্র দেখে এর প্রমাণ মেলে। মার্চ থেকে ধারাবাহিক কমছে প্রবাসী আয়। এতে গ্রামীণ জনপদের মানুষরা সমস্যায় পড়বে। থমকে যাবে গ্রামীণ অর্থনীতি। কারণ গ্রামীন অর্থনীতি চাঙ্গা করতে প্রবাসী আয়ের বিকল্প নেই। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা সহ বড় বড় কোম্পানিগুলো বলছে, করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিবে। তাই এখনি খাদ্য উৎপাদনে কৃষির দিকে জোর দিচ্ছে উন্নত দেশসহ প্রায় প্রতিটি দেশ। করোনা পরবর্তী সময়ে আশার আলো একটাই। পৃথিবীতে বাচতে হলে কৃষিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আর ফিরতে হতে পারে বাপ-দাদার ঐতিহ্য কৃষিতেই।
৬. কৃষি প্রদান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের একটা বড় সুখ্যাতি আছে। সুজলা-সুফলা এই মাটিতে বরাবর কৃষি উৎপাদন ভালো হয়। করোনা মহামারির এই সময়েও দেশে বাম্পার ফলন হয়েছে। পৃথিবীর বড় বড় মোড়লরা যখন কৃষিতে উৎপাদন বাড়ানো নিয়ে ব্যস্থ, তখন আমরা ঘরে তুলেছি সোনার ধান। তবে এখানে বড় সংশয় কৃষকরা ধানের দাম পাওয়া নিয়ে। এছাড়া আরেকটি বড় সমস্যা সাপ্লাই চেইন নিয়ে। কথা হয়েছিল দেশের বেসরকারি খাতের বড় থিঙ্কট্যাঙ্ক সিপিডির গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমেরর সঙ্গে। তিনি বলেছিন, এই মূহুর্তে স্বাস্থ্য সুরক্ষার পরে কৃষিতে জোর দিতে। মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটাতে বা বাচাঁতে হলে কৃষি উৎপাদনের বিকল্প নেই। এই সময়ে যেহেতু আমাদের ফলন ভালো হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কৃষক থেকে শুরু করে পাইকারি বেপারি সবাইকে আরো সক্রিয় করে তুলতে হবে। আর করোনার অভিঘাতে যদি অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থান কমে যায় এসব শ্রমিক হয়তো কৃষি খাতে ফিরতে পারেন। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতেও খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। কারণ যে হারে স্বাস্থ্য খাতে উদ্বেগ বাড়ছে, করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকা-ে ফেরা আরো দীর্ঘায়িত হতে পারে।