করোনা যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্ব ও বাংলাদেশ

3
Spread the love

 শেখর দত্ত

করোনা মহামারিতে বিশ্বে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা তেমন কমছে না। কোনো কোনো দেশে কমতির দিকে থাকায় লকডাউন ক্রমে শিথিল করছে। কিন্তু এটা করার পর আবার বাড়বে কিনা কিংবা কবে মৃত্যু বন্ধ হবে তা নিয়ে শঙ্কা কাটছে না। আমাদের দেশে আক্রান্তের সংখ্যা কিছু বাড়তে থাকলেও মৃত্যু কমবেশি একই থাকছে। মহামারির আকার নিবে কিনা তা প্রতি দিনক্ষণের দুশ্চিন্তায় পরিণত হয়েছে। ২৭ এপ্রিল ২০২০ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, মহামারি শেষ হতে এখনো অনেক বাকি, নির্মূল করতে হলে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্ত্বেও ধারণা করা চলে, যত মৃত্যু আর দুঃখ যাতনাই মানব সমাজকে সইতে হোক আগামী দিনে মহামারি থেকে মানব জাতি আর সেই সঙ্গে জাতি হিসেবে আমরাও মুক্তি পাব।

এদিক অর্থনৈতিক সমস্যা বাড়ছে। এপ্রিলের মাঝামাঝি ইন্টারন্যাশনাল মনিটরিং ফান্ডের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক সতর্ক করে বলেছে, ‘এটা এখন স্পষ্ট যে, ১৯৩০-এর দশকের অতিমন্দার পর সবচেয়ে ভয়াবহ মন্দার সামনে দাঁড়িয়ে পৃথিবী। বিশ্ব আগামী দুই বছরে ৯ ট্রিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি হারাবে। এই অঙ্ক জার্মানি ও জাপানের মতো দুই শিল্পোন্নত দেশের মোট জিডিপির পরিমাণের চেয়ে বেশি।’ আইএমএফের তথ্যানুযায়ী, ‘২০০৯ সালে মহামন্দার পর বিশ্ব অর্থনীতি ০.৭ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়েছিল। এবার তা হতে যাচ্ছে ৩ শতাংশ।’ মহামারির কারণে লকডাউনের সময় যত বৃদ্ধি পাবে ততই ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। অর্থনীতির ওপর তীব্র নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ছাড়া অতি মহামারি রোধ করার আর কোনো উপায় নেই বলেও স্বীকার করছে সংস্থাটি। প্রশ্ন হলো এই মহামারি ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে গভীর ও বিস্তৃত ক্ষত সৃষ্টি করে চলেছে এবং আরো যতটুকু করবে, তাতে বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কি রূপ ও প্রকৃতি নিয়ে দাঁড়াবে? তাতে আমাদের অবস্থান ও অবস্থাইবা কি হবে? এটা সর্বমহলেই স্বীকৃত যে, অর্থনৈতিক সংকটের পিছু পিছু আছে রাজনৈতিক সংকট। রাজনৈতিক সংকট অর্থনৈতিক সংকটকে আরো তীব্র করে এবং দুয়ে মিলে সার্বিক সংকট মানব জাতিকে মৃত্যু ও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। ১৯৩০ সালের অর্থনৈতিক সংকট বিশ্ব পরিম-লে ফ্যাসিবাদের উত্থান ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানব জাতিকে নিপতিত করেছিল। কিন্তু মানব সভ্যতা ওই ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়েই নতুনভাবে আরো শক্তি সামর্থ্য নিয়ে জেগে উঠেছে। এরপরও বিশ্ব যেমন সার্বিক সংকটে পড়েছে, তেমনি জোয়ার-ভাটার মতো আবার জেগে উঠেছে।

প্রসঙ্গত, বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা যখন গভীর সংকটে, সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রইকা চলছে; তখন তাত্ত্বিকদের সঙ্গে আলোচনার জন্য সিপিবির পক্ষ থেকে প্রয়াত অজয় রায় ও আমি সোভিয়েত ইউনিয়নে গেলে আলোচনায় কথা উঠেছিল, জার্মানি পরাজিত হলো, দ্বিখ-িত হলো, যুদ্ধে ক্ষতিপূরণ দিল; এতদসত্ত্বেও দেশটি এত দ্রুত অর্থনৈতিক-রাজনৈতিকভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারল কীভাবে? কেন সোভিয়েত ইউনিয়ন এমন সংকটে নিপতিত হলো? প্রশ্নের গৎবাঁধা উত্তর তখন পাওয়া গিয়েছিল। অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে, গৎবাঁধা উত্তর যেমন তেমনি পথও নেই। সংকট যেমন গভীর মর্মযাতনায় অসংখ্য প্রশ্নের জন্ম দেয়, তেমনি প্রয়োজনীয়তাই প্রশ্নের উত্তর ও পথের দিশা নির্দেশ করে। তাই করোনা-পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় প্রশ্নের উত্তর ও পথের দিশা খুঁজতে কি হতে পারে করোনা-পরবর্তী বিশ্ব রাজনীতির রূপ ও প্রকৃতি তা বিবেচনার মধ্যে রাখা অতি জরুরি বিষয়।

বিশ্বায়ন বা গ্লোবালাইজেশন অভিধাটির সঙ্গে বিশ্ববাসী সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিগত বিংশ শতকের শেষভাগে পরিচিত হয়। এটি এমন একটি আন্তর্জাতিক অবস্থা যাতে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা দেশের গ-ি অতিক্রম করে বিশ্ব পরিম-লে বিস্তৃত হতে থাকে। তাতে মানব সমাজ বিশ্বগ্রামের বাসিন্দা হয়ে যায়। অতীতে একটি গ্রাম যেমন স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিয়ে সুখ-দুঃখ, ধনী-গরিব, ধনবৈষম্য-পেশাভিন্নতা, ঐক্য-বৈচিত্র্য নিয়ে থাকত, ঠিক তেমনি এক বিশ্বগ্রাম গড়ার প্রক্রিয়াও রোখার সাধ্য কারো নেই বলে বিশ্বাস করা হতো। ঠা-াযুদ্ধ যুগের সোভিয়েত ইউনিয়ন যেহেতু নেই, তাই এককেন্দ্রিক অর্থাৎ আমেরিকাকে কেন্দ্র করেই বিশ্বায়ন আবর্তিত হবে, চাই বা না চাই এটাই মানব জাতির ললাটের লিখন মনে হতো। কিন্তু ২০০১ সালে ৯/১১ ঘটনায় টুইন টাওয়ার ধ্বংসের প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের পর এককেন্দ্রিক বিশ্বায়নের মিথ ভেঙে যায় এবং ক্রমে ভূ-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক স্বার্থের লড়াইতে বিশ্বায়ন বহুকেন্দ্রিক বা অঞ্চলভিত্তিক রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে চীন, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত প্রভৃতি কয়েকটি দেশের সঙ্গে আণবিক বোমা সজ্জিত উত্তর কোরিয়া পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। এতে আঞ্চলিক যুদ্ধ-ধ্বংসের সঙ্গে বিশ্বে যুদ্ধের উত্তেজনা বেড়েই চলছে। আণবিক বোমা থাকার কারণেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ পাশ কাটানো সম্ভব হলেও বাণিজ্য যুদ্ধ এর পরিণাম। কিন্তু করোনা যুদ্ধ এসে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়ে গেল আসলেই এই বিশ্বগ্রামের বাসিন্দা আমরা। অতীতে কলেরা-বসন্ত প্রভৃতি মহামারিতে ধনী-গরিব প্রভৃতি নির্বিশেষে গ্রাম উজাড় হতো। কিন্তু বিশ্বগ্রাম উজাড় হয়ে অন্য কোনো গ্রামে যাওয়ার উপায় তো মানবজাতির নেই। তাই বিশ্বগ্রামেই বাঙালি কবির (বন্দে আলী মিয়া) কল্পনা মতো ‘আম গাছ জাম গাছ বাঁশঝাড় যেন/মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন..’ থাকার চিন্তা করাটা মানব জাতির জন্য একান্ত জরুরি বিষয়। কিন্তু করোনা-পরবর্তী সময়ে ওই জরুরি কর্তব্যের দিকে কি অগ্রসর হতে পারবে বিশ্বগ্রামের মানুষ? নাকি বিশ্বায়নের বিশ্বজনীনতা-একাত্মতা-সম্প্রীতি-সৌভ্রাতৃত্ব-সৌহার্দ-সহযোগিতার বিপরীতে স্বার্থবাদী-আত্মসর্বস্ব-সংকীর্ণ জাতীয়তাবোধ ও শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই পৃথিবীকে আবারো গ্রাস করতে উদ্যত হবে? মানবতার পবিত্র পতাকা উড়বে নাকি হিংসা-লোভ-স্বার্থ-জিঘাংসার সহযোগিতা বিশ্বকে শাসন করবে? স্বাভাবিকভাবেই করোনা যুদ্ধের পর সামরিক তথা আণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও বিলাসিতার ব্যয় ক্রমেই কমিয়ে স্বাস্থ্য-শিক্ষা-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি গবেষণা-পরিবেশ সুরক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস দাবি করবে। কিন্তু তা করতে পারবে কি বিশ্বসমাজ, অশুভকে ঠেকিয়ে শুভকে করায়ত্ত করতে?

প্রসঙ্গত, শুভ-অশুভ দুই প্রবণতাই করোনা মহামারির বিপদের মধ্যে পরিদৃষ্ট হচ্ছে। ভয়কে উপেক্ষা করে ডাক্তার-নার্সদের লড়াই, বৈজ্ঞানিকদের ওষুধ আবিষ্কারের প্রচেষ্টা, অন্য দেশকে ওষুধ-সরঞ্জাম-চিকিৎসক দিয়ে সাহায্য, সম্পদশালী মানুষদের অর্থ মানবতার সেবায় প্রদান, টাকা ছাপিয়ে হলেও মানুষ বাঁচানো ও অর্থনীতি সচল রাখা প্রভৃতির ভেতর দিয়ে এই ধারা পরিদৃষ্ট। আমাদের দেশ যখন করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তখনো মালদ্বীপকে আমরা লড়াইতে সাহায্য করেছি। মনোবেদনার সঙ্গে বলি, মতাদর্শগত কারণে অন্য দেশের সাহায্য-সহযোগিতার বিষয়টা অনেকেই সামনে আনেন, আমাদেরটা বলি না। আমাদের ক্ষুদ্র অথচ প্রয়োজনীয় সাহায্য করা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঠাট্টা-মশকরা করাটাও লক্ষ করেছি। কিন্তু ক্ষুদ্র হলেও যে আমরা শুভর নিদর্শন রাখতে পারছি এর তাৎপর্য বিশাল। এই ধারার বিপরীত অশুভ ধারাও চলমান। ত্রাণ চুরি করা, শ্রমিকদের বেতন না দেয়া, কারখানা লে-অফ করা, শ্রমিকদের ঢাকায় ডেকে আনা আর ফেরত পাঠানোর খেলা প্রভৃতির ভেতর দিয়ে এটা পরিদৃষ্ট। এদিকে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আমেরিকা-চীন বাহাস চলছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট চীনা ভাইরাস তথা রাসায়নিক পরীক্ষাজাত বলা ও তথ্য গোপন করায় চীনকে অভিযুক্ত করা, চীনের বিরুদ্ধে মামলা করা, চীন সুযোগ বুঝে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে নাক গলাতে চাইছে প্রভৃতি বলার ভেতর দিয়ে আমেরিকা-পরবর্তী সময় কি করতে যাচ্ছে এটা সুস্পষ্ট।

এদিকে ‘পাশ্চাত্যের মন্দা কাজে লাগিয়ে চীন সেরা হতে চায়’, ‘জিততে কি চলেছে চীন’ প্রভৃতি প্রচার তুঙ্গে। গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র সচিব ও ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ডোমেনিক রাব বলেছেন, সংকট মিটে গেলেও চীনের সঙ্গে আর কখনো স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে না। এপ্রিলে সুইজারল্যান্ডের দোভাসে ইউরোপের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি পরবর্তী বিশ্ব নিয়ে আলোচনায় মিলিত হলে যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দলের সদস্যরা চীনের বিরুদ্ধে জি ফাইভ তথ্য পাচারের অভিযোগ তুলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিযোগিতা কমিশনের প্রধান মার্কগ্রেথ শেয়ার বাজারে চীনের কারসারি ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে পরামর্শ দিয়েছেন। এপ্রিলের প্রথম দিকে পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকার সংবাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চীন থেকে শিল্প ও ব্যবসার ‘পাততারি গুটিয়ে’ ২০০টি মার্কিন সংস্থা ‘ভারতকে উৎপাদন কেন্দ্র’ বানাতে চাইছে।

উল্লিখিত সব পারস্পরিক বিতর্ক-বিরোধ করোনা-পরবর্তী সময়ে কি রূপ ও প্রকৃতি নিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা প্রায় অসম্ভব। তবে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে সুস্পষ্ট, যে নামেই যুদ্ধ হোক না কেন, তারপর বিশ্বের মানচিত্র থেকে শুরু করে ব্যবস্থাদি সব পাল্টে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া, ঠা-াযুদ্ধ যুগের পর ওই দুনিয়ার পতন, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে পর ভূমি-রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের নড়চড় বিশেষভাবে ডিজিটাল বিপ্লব প্রভৃতি এর প্রমাণ। এটা তো ঠিক, ঠা-াযুদ্ধ যুগের মতো ভাবা যায় না, এক তত্ত্ব-মত-পথের পতাকা সারা বিশ্বে উড্ডীন হবে। আসলে বৈচিত্র্য আর ঐক্যের মধ্যেই ‘মেঘলোকে উধাও’ থাকবে বিশ্ব সভ্যতা। এই অবস্থায় করোনা-পরবর্তী বিশ্বে অস্থিরতা অনিশ্চয়তা পাশ কাটিয়ে কতটা যুক্তিযুক্ত ভারসাম্যমূলক ও গণবান্ধব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক পদক্ষেপ নিতে পারে বাংলাদেশ, তার ওপরেই নির্ভর করবে আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ।

শেখর দত্ত : রাজনীতিক ও কলাম লেখক।