– ইয়াকুব আলী
পৃথিবীজুড়ে এখন সবচেয়ে আলোচিত নাম করোনা। খালি চোখে দৃশ্যমান নয় এমন একটা ভাইরাস সারা বিশ্বের চেহারাই পাল্টে দিয়েছে রাতারাতি। মানুষ এখন অনেকটাই ঘরবন্দি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যেন প্রকৃতি একটু বিশ্রাম নিয়ে নিচ্ছে। সেই সাথে মানুষকেও অনেক কিছু উপলব্ধি করার সুযোগ করে দিচ্ছে। আমরা প্রায়শই নিজেদের কিছু স্বপ্নের কথা বলতাম যেমন: বাচ্চারা বলতো, স্কুল না থাকলে ভালো হয়, স্ত্রী চাইতো তার স্বামী যেন সারাক্ষণ তার আশেপাশে থেকে তাকে সংসারের কাজে সাহায্য করে, স্বামী চাইতেন অফিস থেকে একটু অবসর। করোনাভাইরাস মনে হয় সবার মনের কথাটাই পড়তে পেরেছিলো। তাই সবার মনের আশাই কম বেশি পূরণ হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টি দিলে বুঝা যাবে, করোনাভাইরাস তার কর্তৃত্ব পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
করোনা একেবারে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় শ্রেণী বৈষম্য কতটা প্রকট। পাশাপাশি এটাও দেখিয়ে দিলো, শহর এবং গ্রামের মধ্যে জীবনপ্রণালী এবং মানসিকতার বিস্তর ফারাক। বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থা বুঝানোর জন্য বিজ্ঞ জনেরা যতই উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি এবং জিডিপি’র কথা বলুক না কেন, করোনা দেখিয়ে দিলো, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোরই এখন পর্যন্ত কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। করোনা আক্রান্তের পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে শুরু থেকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বাগাড়ম্বর করে আসছিলো তাদের পূর্ব প্রস্তুতি আছে। কিন্তু বাস্তবিকই যখন করোনা মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো, তখন দেখা গেলো করোনা মোকাবিলায় সরকারের কোনো পূর্ব প্রস্তুতি তো ছিলোই না বরং কোন প্রকার সমন্বয়ও নেই। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর কোন মন্ত্রীকেই আর দেখা গেলো না। শুধুমাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিভিন্ন রকমের ভুলভাল তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলেছেন। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী নিজে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে এলেন। করোনা মোকাবিলায় একটা সমন্বয় সেল গঠন করলেন যার তদারকি স্বয়ং তিনি নিজেই করবেন।
বাংলাদেশের চিকিৎসায় কোন ত্রুটি হলেই সবাই সরাসরি ডাক্তারদের দিকে আঙ্গুল তোলেন। করোনা ছড়িয়ে পড়া শুরু করলেও এমনই একটা ধোঁয়া তুলে সমগ্র স্বাস্থ্যসেবার ভঙ্গুর দিকটা আড়াল করার চেষ্টা করা হলো। কিন্তু দিনশেষে ডাক্তার এবং নার্সরা করোনায় আক্রান্ত হয়ে সেটা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। শুরুতেই পিপিই’র সংকট দেখা দিলো। সেখানে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনও এগিয়ে এসেছে। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যে পিপিই সরবরাহ করা হয়েছিলো, সেগুলো না কি নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ডের ছিলো না। পিপিই যদি নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ডের না হয়, তখন সেটা জীবনের সুরক্ষা না করে মরণঘাতী হয়ে যায়। ইতোমধ্যেই করোনা আক্রান্ত বিভিন্ন প্রকারের স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা তিনশ ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে করোনা শনাক্তকরণের জন্য সুলভ মূল্যের কিট তৈরি করেও গণস্বাস্থ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মানুষের দেখা পাচ্ছে না। মহামারীর এই সময়েও মানুষ মুনাফাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।
এরপর আসলো করোনা প্রতিরোধের উপায়। জানা গেলো মানুষ যত কম চলাফেরা করবে এই ভাইরাস তত কম ছড়াবে। কারণ এখন পর্যন্ত এই ভাইরাস শুধু মানুষকেই আক্রমণ করেছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে একটা বাঘের শরীরেও করোনার অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিলো বলে খবরে প্রকাশ হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সেটার সত্যতা জানা যায়নি। বাংলাদেশের মানুষকে ঘরে আটকে রাখার জন্য ছুটি ঘোষণা করা হলো, তখন দেখা গেলো সবাই এই ছুটিটাকে কাজে লাগানোর জন্য নিজনিজ গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেলো। আসলে মানুষ শুধুমাত্র পেটের দায়ে ঢাকা শহরে থাকে। তাই সুযোগ পেলেই আবার সে গ্রামের দিকে ছুটে যায়।
মুশকিল হলো, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষদের নিয়ে তাদেরকে পেটের দায়ে ঘরের বাহির হতেই হচ্ছে, যদিও কর্ম অনেক কমে গেছে। সবচেয়ে মুশকিল হলো, গার্মেন্টস কর্মীদের নিয়ে। তারাও ছুটি পেয়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেলো। কিন্তু মাঝপথে আবার কারখানা খুলে গেলো। তাই তাদেরকে ফিরে আসতে হলো। যেহেতু রাস্তাঘাটে সমস্ত পরিবহন বন্ধ তাই তাদেরকে ফিরতে হলো পায়ে হেটে। আবার কেউবা ফিরে আসলেন মালামাল পরিবহনের কন্টেইনারে করে। এমনকি অনেকে মাছ পরিবহনের ড্রামে বসেও ফিরে আসলেন। মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সমালোচনার মুখে আবারও কারখানা বন্ধ করে দেয়া হলো, তখন গার্মেন্টস কর্মীরা পড়লেন উভয় সংকটে। ঘরের বাহির হলে করোনায় আক্রান্ত হবার ভয়, আবার কাজে না গেলে পেটে ভাতও জুটবে না। অবশেষে কারখানাগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। কারণ করোনা মাফ করলেও ক্ষুধা এই মানুষগুলোর নিত্যসঙ্গী।
এর মধ্যেই অবশ্য খবর পাওয়া গেলো অনেক গার্মেন্টসে কর্মীদের বেতন না দিয়েই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই শ্রমিকেরা লকডাউন উপেক্ষা করে মজুরির দাবিতে রাস্তায় রাস্তায় আন্দোলন করছে। এছাড়াও গার্মেন্টস খোলা বা বন্ধ থাকা নিয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে কারখানার মালিক শ্রেণী নিজেদেরকে শ্রমিকদের মালিক বলেই দাবী করে বসলেন। ব্যাপারটা অনেকটা আগেকার দিনের আদম ব্যবসার মতো। যেখানে মানুষ বেচাকেনা হতো এবং প্রত্যেক শ্রমিকের একজন করে মনিব থাকতো। এই যদি হয় বাংলাদেশের সার্বিক সামাজিক অবস্থা, সেখানে বিভিন্ন মানদ-ে বাংলাদেশের উন্নয়ন কতখানি ঠুনকো তা সহজেই অনুমান করা যায়। সামান্য মানবতার যেখানে ঠাঁই নেই, সেখানে এইসমস্ত উন্নয়ন খুবই বেখাপ্পা দেখায়।
এর মধ্যেই লকডাউনে থাকা ধনী শ্রেণীর বিভিন্ন প্রকারের বিলাসিতার প্রচারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সয়লাব। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৯.৮০ শতাংশ ফেসবুক ব্যবহার করেন। তার মানে এখানে শুধুমাত্র এই শতাংশ মানুষের সমস্যা এবং ধ্যান ধারণায় প্রতিফলিত হয়। যেমন তারা গরীব মানুষগুলোর বাইরে বের হওয়া নিয়ে খুবই খিস্তি করছে। আসলে ঘটনা এমন যে, তারা এই মানুষগুলোর জীবন নিয়ে শংকিত না। করোনা সংক্রমণ বাড়লে তারা ঘরের মধ্যে বসে মন্ডা মিঠাই খেয়েও রক্ষা পাবে না। সেই জন্যই তারা এগুলো করছে। এর পাশাপাশি তারা ভালো থাকার অভিনব সব পন্থা বের করছে যেগুলো দেখলে বুঝা যায় তাদের অন্তরটা কতটা অন্তঃসারশূন্য। যাইহোক তবুও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণেই সরকার অনেক ভালো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।
করোনা আবারও বাংলাদেশের শ্রেণী বৈষম্যটা সামনে নিয়ে এসেছে। করোনার রোগীদের মধ্যেও ভিআইপি এবং সাধারণ মানুষ খোঁজা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ভিআইপি রোগীদের জন্য আলাদা হাসপাতাল বানানোর কাজ শুরু হয়েছিলো, পরবর্তীতে সমালোচনার মুখে সরকার পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে এমন কোন কিছুই করার পরিকল্পনা সরকারের নেই। কিন্তু আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি সরকার যদি কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে চায়, কেউই সেটা আটকাতে পারবে না। এছাড়াও শুরু হয়েছে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বিভিন্ন প্রকার প্রণোদনা ঘোষণা। সেখানেও দেখা যাচ্ছে চাকরির শ্রেণী অনুযায়ী প্রণোদনারও শ্রেণী আছে। আমার ভাবতে খুবই অবাক লাগে, শ্রেণী ব্যবধানে মানুষের যদি শারীরিক গঠনে এবং ক্ষুধার তারতম্য না থাকে, তাহলে প্রণোদনার মধ্যে শ্রেণী ব্যবধান করাটা নিতান্তই হাস্যকর।
এরপর আসছে সাধারণ মানুষকে সাহায্য করার বিষয়টা। যেটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য খুবই জরুরি। কারণ দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোর জন্য এটাই ঘরে থাকার একমাত্র উপায়। ত্রাণ বন্টন নিয়ে চলছে এক ধরণের হরিলুট। আমরা যারা গ্রামের ছেলেমেয়ে, তারা ছোটবেলা থেকেই মেম্বর চেয়ারম্যানদের এইসব চুরি দেখে দেখে অভ্যস্ত। ফেসবুকের কল্যাণে এবার সেটা সকলেই জেনে গেছে এবং শহুরে ভদ্রলোকেরা খুবই অবাক হয়েছেন। আসলে সম্পদের সুষম বন্টন হলে কবেই বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র পালাতো। কিন্তু সেটা যে এখনও হয়নি করোনা সেটা দেখিয়ে দিলো। চাল ডাল থেকে শুরু করে কি নেই চুরির তালিকায়। এরপর গোদের উপর বিষফোঁড়া হিসেবে শুরু হয়েছে আরেক অত্যাচার যার নাম ধান কাটা। স্থানীয় থেকে শুরু করে জাতীয় জনপ্রতিনিধিরা নিজেদেরকে দেশপ্রেমিক এবং কৃষি ও কৃষক প্রেমিক প্রমাণ করতে ক্ষেতে নেমে যেয়ে ধান কাটছেন। সাথে করে নিয়ে যাচ্ছেন একগাদা ক্যামেরা। উনাদের পোশাক পরিচ্ছদ দেখলেই বুঝা যায় যে, উনারা ধান কাটার মডেলিং করছেন। অনেকে আবার কাঁচা ধান কেটে ফেলছেন ভুল করে। আর উনাদের কেটে যাওয়ার পর ক্ষেতের ধান গোছাতে যেয়ে কৃষকের বাড়তি খরচ গুণতে হচ্ছে।
এতকিছুর পরও মানবতা বেঁচে আছে তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। দাঁড়াচ্ছেন দুর্গত মানুষ এবং কৃষকের পাশে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন, মানুষ মানুষের জন্য নিজেদের ঘাড়ে তুলে নিয়েছেন অনেক দায়িত্ব। বিদ্যানন্দ ইতোমধ্যেই অত্যন্ত সুশৃংখলভাবে ত্রাণ বিতরণ করছে সেনাবাহিনী এবং বিজিবির সহায়তায়। এতে করে তাদের সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত হচ্ছে। মানুষ মানুষের জন্য ডাক্তারদের পিপিই তৈরি এবং বন্টনের পাশাপাশি এখন ত্রাণ বন্টনেও হাত দিয়েছে এবং বেশ ভালোভাবেই তাদের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। আর এইসব বেসরকারি উদ্যোগে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশিরা। তারা তাদের সর্বোচ্চ দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। এভাবেই আসলে বিভিন্ন প্রকার মহামারী পার করে মানব সভ্যতা টিকে থাকে।
যখন করোনার প্রকোপ শুরু হলো, তখন ভেবেছিলাম করোনাকালীন বাংলাদেশ হবে একটা শ্রেণী বৈষম্যহীন বাংলাদেশ। কারণ করোনা ধনী গরীব, শিক্ষিত অশিক্ষিত, আমলা চাষী কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সমস্যাগুলো আরো প্রকট আকার ধারণ করছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই শংকিত। কারণ করোনা উত্তর বাংলাদেশের দরকার হবে অনেক খাদ্যের, যার যোগানদাতা আমাদের কৃষক কিন্তু এখন পর্যন্ত কৃষকদের বাঁচানোর জন্য কার্যকরী কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। উপরন্তু তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম না পেয়ে সেটা রাস্তায় ফেলে যাচ্ছেন, এমনটাই দেখা যাচ্ছে। তাই করোনা উত্তর বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ আসন্ন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এখনই কৃষকদের জন্য উপযুক্ত প্রণোদনা ঘোষণার মাধ্যমে ধান থেকে শুরু করে সকল খাদ্য শস্যের সংগ্রহ নিশ্চিত করতে হবে, তাহলেই শুধুমাত্র বাংলাদেশের মানুষ বাঁচবে।
(চ্যানেল আই অনলাইন-এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক খুলনাঞ্চল-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)