যশোরে বিষাক্ত মদপান: পাঁচ দিনে মৃত্যু ১৫, আটক ১

2
Spread the love

যশোর অফিস

যশোরে বিষাক্ত মদপানে মৃত্যুর মিছিল থামছে না, গত পাঁচ দিনে জেলা সদরসহ তিনটি উপজেলায় ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মাহমুদুল হাসান নামে এক অবৈধ দেশি মদের ব্যবসায়ীকে আটক করেছে পুলিশ। মৃতদের পরিবারের সদস্য, হাসপাতাল ও পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মিলিয়ে অ্যালকোহল পানে মৃত্যুর এমন সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে বহুল আলোচিত হাসান ও মোতালেবের দোকানের বিষাক্ত বা ভেজাল মদপানে এই পর্যন্ত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছে প্রশাসন। মৃতদের মধ্যে যশোর শহর ও শহরতলী ছাড়াও চৌগাছা ও মণিরামপুর উপজেলার বাসিন্দারা রয়েছেন। ইতিমধ্যে আটক হাসানের দোকানে তল্লাশি করে সেখান থেকে মদের স্যাম্পল উদ্ধার করে পরীক্ষাগারে পাঠিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ভেজাল বা বিষাক্ত মদপানে রবিবার নতুন করে যে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে, তারা শহরের রেলগেট চোরমারা দীঘির পাড় ও বেজপাড়া টিবি কিনিক এলাকার বাসিন্দা। মৃতদের মধ্যে একজন বিকাশ সাহানি (৩৮), অন্যজন ওজিয়ার ওরফে ওলিয়ার। বিকাশ শহরের বেজপাড়া টিবি কিনিক এলাকার দামোদর সাহানির ছেলে। আর ওলিয়ার শহরের রেলগেট চোরমারা দীঘির পাড়ের মৃত কুরবান গাজীর ছেলে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ব্রাদার মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, রবিবার সকাল দশটা আট মিনিটে বমি, মাথা ঘোরাসহ বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ওলিয়ার। আসলে তিনি অ্যালকোহল পয়জনিংয়ের শিকার। জরুরি বিভাগ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ওলিয়ারকে মেডিসিন ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেন কর্তব্যরত ডাক্তার। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে তার মৃত্যু হয়। মেডিসিন ওয়ার্ড থেকে রিপোর্ট আসার পরে জরুরি বিভাগের খাতায় তথ্য সংশোধন করে ‘অ্যালকোহল পয়জনিং’ লেখা হয় বলেও জানান এই ব্রাদার। হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে দায়িত্বরত চিকিৎসক রুবেল হাওলাদার বলেন, ‘বিকাশ সাহানি রাত দুইটা ২৫ মিনিটে শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতা নিয়ে ভর্তি হতে আসে। তখন আমার সন্দেহ হয়েছিল। রোগীর কেস হিস্ট্রি জেনে চিকিৎসা দেওয়ার স্বার্থে বিকাশের পরিবারের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তারা জানায়, সে মদ খেয়েছে। ভোর চারটার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকাশ মারা যায়।’ পান করা অ্যালকোহলে পয়জন থাকার কারণে বিকাশের মৃত্যু হয় বলে মনে করছেন ডাক্তার রুবেল। এ দুইজনের অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কোতয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। আগে থেকেই পুলিশ বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখছে। অপরদিকে চৌগাছায় দুই ট্রাকচালকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। শনিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে একজন মারা যান। রাঙি (৪৫) নামে এই ব্যক্তি একজন আদিবাসী। বংশপরম্পরায় তারা মদ সেবনে অভ্যস্ত।

এর আগে এদিন বিকেলে খলিলুর রহমান নামে (৩৭) এক ট্রাকচালকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। স্থানীয়দের ধারণা, বিষাক্ত মদপানে এই দুই ট্রাকচালক মারা গেছেন। পুলিশের সন্দেহও তেমনই। যদিও থানার প্রধান পুলিশ কর্মকর্তা এই বিষয়ে খোলসা করে কিছু বলেননি। এছাড়া শরিফুল ইসলাম (৩৬) নামে আরেক ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনিও মাদকসেবী হিসেবে পরিচিত। তার বাড়িতে শনিবার রাতেই জনপ্রতিনিধিসহ পুলিশ কর্মকর্তারা গিয়েছিলেন। শনিবার মৃত্যু হয়েছে চারজনের। তারা হচ্ছেন যশোর সদর উপজেলার শেখহাটির আরশাদ আলীর ছেলে শাহিন হোসেন (৩৫), চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের খিতিবদিয়ার শাহজাহান সরদারের ছেলে ইনামুল হোসেন (৩৯), ঝিকরগাছা উপজেলার কাটাখাল গ্রামের সাহেব আলী (৬৫) ও মণিরামপুর উপজেলার মদনপুর গ্রামের তপন হালদার (৪০)।  যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তাদের। বৃহস্পতিবার রাত ও শুক্রবার মৃত্যু হয় মণিরামপুর উপজেলার মদরপুর গ্রামেরআব্দুর রাজ্জাকের ছেলে মোমিন (৪৮), একই গ্রামের মুক্তার হোসেন (৪৭), যশোর শহরের গরীব শাহ মাজার এলাকার শরিফ উদ্দিন ওরফে মনি বাবু (৪৫), ঘোপ নওয়াপাড়া রোডের সাবুর (৪৬), বেজপাড়ার নান্টু (৩৫), ঝুমঝুমপুর মান্দারতলার ফজলুর রহমান চুক্কি (৫০), চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের ছাতিয়ানতলার বাসিন্দা আক্তারুজ্জামান (৪৫)। এদিকে, এ সব মৃত্যুর ঘটনায় বহুল আলোচিত ভেজাল ও বিষাক্ত মদের কারবারি মাহমুদুল হাসান ওরফে হাসানের বিরুদ্ধে কোতয়ালি থানায় মোট পাঁচটি মামলা (নম্বর ৪৩, ৪৪, ৪৫, ৪৬ ও ৫০, তারিখ ২৫.৪.২০) হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি মামলায় মদ খাইয়ে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। অন্য দুটি মামলায় অবৈধভাবে মদ বিক্রির অভিযোগ আনা হয়েছে। পুলিশ সূত্র জানায়, একটি মামলার বাদী যশোর শহরতলীর ঝুমঝুমপুর বালিয়াডাঙ্গা এলাকার মৃত ফজলুর রহমান চুটকির স্ত্রী সাথী বেগম (৪০)।  অন্য দুটি মাদক মামলার বাদী থানার এসআই কাইয়ুম মুন্সি ও এসআই হারুনার রশিদ। কোতয়ালি থানার ইনসপেক্টর (তদন্ত) শেখ তাসনিম আলম মদের কারবারি হাসানের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, এর মধ্যে তিনটি হত্যার, দুটি মাদকের। থানার ওসি মনিরুজ্জামান জানান, হাসানকে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তার জবানবন্দি নিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে। অপরদিকে মোতালেব নামে আরও একজন অবৈধ ও ভেজার মদ ব্যবসায়ীকে খুঁজছে পুলিশ। ঘটনার পর থেকে সে পলাতক বলে জানিয়েছে পুলিশ। লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও তারা দীর্ঘদিন ধরে মদের কারবার করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। শহরের কেন্দ্রস্থলে কোতয়ালি থানা ও মাড়োয়ারি মন্দির-সংলগ্ন পতিতালয়ের গা-ঘেঁষে হাসানের দোকান। মোতালেবের দোকান পাশের বাবুবাজার পতিতালয় এলাকায়। অভিযোগ আছে, হাসান ও মোতালেবসহ বেশ কয়েক ব্যক্তি ওই এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বেআইনিভাবে মদ বেচা-কেনা করলেও কর্তৃপক্ষ দেখেও দেখে না। ওপেন সিক্রেট এই কারবার নাকি কর্তৃপক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করেই চালানো হয়।