বিশেষ প্রতিনিধি
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিজের হাতে গুলি করে হত্যাকারী রিসালদার (বরখাস্ত) মোসলেম উদ্দিন খানের দুই মাস ধরে কোন হদিস নেই। ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) মাজেদের ভাগ্যই কি বরণ করতে যাচ্ছে রিসালদার (বরখাস্ত) মোসলেম উদ্দিন! গত ১১ এপ্রিল ফাঁসি কার্যকর হওয়া ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আব্দুল মাজেদ কলকাতায় থাকার সময়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল রিসালদার (বরখাস্ত) মোসলেমউদ্দিনের। মাজেদ আটক হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদের সেই তথ্য সূত্রে আটক হয় মোসলেমউদ্দিন ! কলকাতার পুলিশের উদ্বৃতি দিয়ে ঢাকার গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ জেলার ঠাকুরনগরে ইউনানি চিকিৎসক পেশায় থেকে ডাঃ সমীর দত্ত ছদ্মনাম নিয়ে লুকিয়ে ছিল মোসলেমউদ্দিন। গত দুই মাস ধরে ওই এলাকায় দেখা যাচ্ছে না তাকে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতার পার্কস্ট্রিট থেকে আরেক খুনী ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদ যেদিন নিখোঁজ হয়, সেদিন থেকেই ঠাকুরনগর এলাকার চাঁদপাড়া রোডের বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেছে রিসালদার (বরখাস্ত) মোসলেমউদ্দিন। ঢাকার এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদ কলকাতার পার্কস্ট্রিটের বেডফোর্ড লেনের বাসা থেকে নিখোঁজ হয় গত ২২ ফেব্রুয়ারি। ওইদিন রাতেই পার্কস্ট্রিট থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী সেলিনা বেগম ওরফে জরিনা বেগম। গত ২২ ফেব্রুয়ারি মাজেদ কলকাতা থেকে নিখোঁজ হওয়ার পর ঢাকায় গ্রেফতার হয় ৭ এপ্রিল। এর চার দিন পর ১১ এপ্রিল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে নিখোঁজ হয়ে গত ১১ এপ্রিল ঢাকায় গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় দেড় মাস নিখোঁজ ছিল মাজেদ। মাজেদের দেয়া জবানবন্দী অনুযায়ী যদি মোসলেমউদ্দিনের সন্ধান পাওয়া যায় তবে তখন থেকেই মোসলেমউদ্দিনও নিখোঁজ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। হয়তো বা হঠাৎ একদিন শোনা যাবে মোসলেমউদ্দিন গ্রেফতার। অতপর মাজেদের মতোই ভাগ্য বরণ করতে হবে মোসলেমউদ্দিনকেও।
কলকাতার পুলিশের উদ্বৃতি দিয়ে ঢাকার গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ জেলার ঠাকুরনগরে চাঁদপাড়ায় লুকিয়ে ছিল মোসলেমউদ্দিন। তার ছদ্মনাম সমীর দত্ত, পেশায় ইউনানি চিকিৎসক। চিকিৎসা বিষয়ে একটা বইও লিখেছে। সেটি গত বছরের শেষদিকে প্রকাশ হয়েছে। বইয়ে নিজের নাম লিখেছে দীপক চক্রবর্তী নামে। ওই ব্যক্তি সর্বশেষ উত্তর চব্বিশ পরগণায় ছোট্ট একটি ঘরে থাকত। বাড়ির মালিক জানিয়েছেন, তার কেউ না থাকায় তাকে এই বাড়িতে আশ্রয় দেয়া হয়। তবে ২০১০ সালের আগ পর্যন্ত মাঝে মাঝে সে ১০/১৫ দিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে যেত। সে ফোন ব্যবহার করত না। তার কোন চিঠিও আসত না। প্রায় ১০ বছর এখানে বসবাস করেছে। ভাল ইংরেজী বলতে পারত। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার সংবাদ মাধ্যমে কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর খুনী মোসলেমউদ্দিন আটক হওয়ার খবর প্রচারের পর কলকাতার পুলিশ খোঁজ নিয়েছে যেখানে মোসলেমউদ্দিন থাকত সেই বাড়িতে। বাড়ির মালিক পুলিশকে বলেছেন, ইউনানি চিকিৎসকের ঘরে তল্লাশি চালিয়ে কবিরাজের কোন বই পাওয়া যায়নি। বরং পাওয়া গেছে, জিহাদের বই, হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক এবং ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে লেখা বই। মোসলেহউদ্দিনের থাকার খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে গিয়ে জানতে পারে, যে সমীর দত্তের পরিচয়ে ওই ব্যক্তি থাকত, সেই সমীর দত্ত মারা গেছেন গত ১০ এপ্রিল। তার সৎকারও করা হয়েছে। পুলিশ এখন সমীর দত্তের ডেথ সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট, ব্যাংক একাউন্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র খতিয়ে দেখছে। ঢাকার গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, কলকাতার পুলিশের দিনক্ষণ তারিখ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর খুনী মাজেদ কলকাতা থেকে নিখোঁজ হয়ে যখন ঢাকায় গ্রেফতার হওয়ার আগে থেকেই ঠাকুরনগরের চাঁদপাড়া থেকে নিখোঁজ হয়ে যায় মোসলেমউদ্দিনও। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি মোসলেমউদ্দিন ভারতে সবশেষে বসবাস শুরু করলেও প্রথমে নাগরিকত্বের আবেদন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আবেদন প্রত্যাখাত হওয়ার পর জার্মানির নাগরিকত্ব চেয়েও পায়নি। এরপর পশ্চিমবঙ্গের গোবরডাঙ্গার ঠাকুরনগর এলাকায় মোসলেম আয়ুর্বেদ ও হোমিও চিকিৎসক হিসেবে পরিচিতি দিয়ে বসবাস শুরু করে। একা থাকত সে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সে দেশ ত্যাগ করে।
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে জার্মানিতে থাকার তথ্য পাওয়া গিয়েছিল মোসলেমউদ্দিনের। এর আগে সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন থেকেও নাগরিকত্ব চেয়ে পায়নি। তখন এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে জার্মানিতে চিঠিও দেয়া হয়। ভারতের কাছেও পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ভারত মোসলেম সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানাতে পারেনি বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, মোসলেমউদ্দিন বঙ্গবন্ধু হত্যার পরই নিজের নাম পাল্টে ফেলেছিল। তার নতুন নাম রফিকুল ইসলাম খান। নতুন এ নাম যুক্ত করেই তার পরিবারের সব সদস্য জাতীয় পরিচয়পত্র পায়। মোসলেমউদ্দিনের পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে। তারা বর্তমানে নরসিংদীতে শিবপুরের দত্তেরগাঁও এলাকায় নাম পাল্টে, বাবা রফিকুল ইসলাম খানের নামে জাতীয় পরিচয় তৈরি করে বসবাস করছে। তার দুই ছেলে এর সত্যতা স্বীকারও করেছে। কলকাতায় গিয়ে মোসলেমউদ্দিন তার নিজের নাম পাল্টে ফেলে দেয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সে নিজের নাম রাখে ডাঃ সমীর দত্ত।
পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজার বলছে, মোসলেমউদ্দিনকে সেখানে আটক করা হয়েছে কিনা, সেটি নিয়ে আছে ধোঁয়াশা। কারণ, এ বিষয়ে কিছুই বলছে না, দু‘দেশের সরকার। ফাঁসির আগে মাজেদ জানিয়েছিল, ভারতে পালিয়ে আছে মোসলেমউদ্দিন। বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনী মোসলেমউদ্দিনকে আটক করা হয়েছে। তাকে হস্তান্তর করা হয়েছে, বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের কাছে। এছাড়া, আরেকটি গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে মৃত্যুর খবর রটিয়ে তার পালিয়ে যাওয়ার খবরও দেয় দৈনিকটি। বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনী বরখাস্ত হওয়া রিসালদার মোসলেমউদ্দিন পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনার শিমুলপুরে তার ছবি দেখালে স্থানীয়রা জানান, এই ব্যক্তিকে তারা চেনেন, সমীর কুমার দত্ত বা দত্ত দা হিসেবে। ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে গ্রামটিতে ইউনানি চিকিৎসা সেবা দেয় সে। তবে, মারা গেছে গত ১০ জানুয়ারি। তাকে দাহও করা হয়েছে। মোসলেমউদ্দিন যে বাড়িতে থাকত সমীর দত্ত পরিচয়ে তার মালিক ইউনানি চিকিৎসক প্রমোদানন্দ অধিকারী। প্রমোদের মেয়ে বলেছে, ৩৮-৩৯ বছর আগে দমদমে তার বাবার সঙ্গে পরিচয় হয় সমীর দত্তের। নিজের কেউ নেই বলে তাদের বাড়িতে থাকার আবেদন করে সে। সেই থেকেই শিমুলপুরে ছিল, সমীর। তেমন মিশুক ছিল না। প্রতিদিন বাংলা-ইংরেজী মিলিয়ে ৭-৮টি দৈনিক পত্রিকা পড়ত। মাঝে-মধ্যে ইংরেজী কথাও বলত। তবে, শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রশ্ন এড়িয়ে যেত। ঢাকার গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, রিসালদার এর অর্থ অশ^ারোহী। অশ্বারোহী সৈন্যদলের অধিনায়ক। ১৯৭৫ সালে ঢাকা সেনানিবাসের অশ্বারোহী সৈন্যদলের অধিনায়ক ছিলেন মোসলেম উদ্দিন। সে কারণে তার পদবি রিসালদার। ১৫ আগস্ট গভীররাতে গোলাগুলির শব্দ শুনে বঙ্গবন্ধু যখন দোতলা থেকে নিচ তালায় সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসছিলেন তখন মোসলেমউদ্দিনই বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি ব্রাশ ফায়ার করে। তার আগে মোসলেমউদ্দিন ফজলুল হক মনির বাড়িতে গিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালায়। শুধু তাই নয়- ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক জাতীয় চার নেতা হত্যা মিশনেও ছিল সে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর মোসলেমউদ্দিন বঙ্গভবনের হত্যাকা-ের অন্যতম রূপকার রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোস্তাক আহমদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পান। তাকে অন্যান্য খুনীদের মতো খন্দকার মোস্তাক পুরস্কৃত করে। সেই ধারা অব্যাহত রাখে জিয়াউর রহমান। রিসালদার মোসলেমউদ্দিন ইরান ও সৌদি দূতাবাসে চাকরি পায়। এরশাদের আমলে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হলেও দেশে ফিরেনি।
১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর দেশে ফিরে আসে। নরসিংদী জেলার শিবপুরের দত্তেরগাঁও গ্রামের বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। তাকে সার্বক্ষণিক পুলিশ দিয়ে নিরাপত্তা দেয় বিএনপি। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সপরিবারে পালিয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন হয়ে পরিবার সদস্যরা ঢাকায় আত্মগোপন করে। মোসলেমউদ্দিন থাইল্যান্ড পাড়ি জমায়। মোসলেমউদ্দিন রফিকুল ইসলাম খান নামে আগে থেকে তার একটি পাসপোর্ট তৈরি ছিল। কয়েক বছর পর উড়ে যায় জার্মানি। সেখানে থাকে রাজনৈতিক আশ্রয়ে। বাংলাদেশ সরকার তার অবস্থান জানার পর জার্মানি ছেড়ে ভারতে চলে যায়। ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ঠাকুরনগরে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। গত ১১ এপ্রিল ফাঁসি কার্যকর হওয়া ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আব্দুল মাজেদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল রিসালদার (বরখাস্ত) মোসলেমউদ্দিনের। জিজ্ঞাসাবাদের দেয়া সেই তথ্য সূত্রে মোসলেমউদ্দিন আটক হয় বলে কলকাতার সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকাটির দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, দুই বছর আগে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে এসে পরিবারের সঙ্গে কয়েকদিন থেকে গেছে মোসলেমউদ্দিন। গত ৭ এপ্রিল খুনী আব্দুল মাজেদ গ্রেফতার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিল, রিসালদার মোসলেমউদ্দিন গ্রেফতার এড়াতে তার নাম রফিকুল ইসলাম খান ধারণ করেছে এবং ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনার ঠাকুরনগরে অবস্থান করে। তার নাম ধারণ করেছে ডাঃ সমীর দত্ত। মোসেলেমউদ্দিনের ছেলে মেয়েরা নরসিংদীতে থাকে। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের সেই সূত্র ধরে আব্দুল মাজেদের ছেলে মেয়েদের খোঁজ নিতে থাকে। এতেই বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল।
বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী রিসালদার মোসলেমউদ্দিন (রফিকুল ইসলাম খান) বর্তমানে ভারতে গোয়েন্দা জালে আটক রয়েছে। আটক হওয়ার আগে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার গোবরডাঙ্গা ঠাকুরনগর চাঁদপাড়া সড়কে ‘ইউনানি ফার্মেন্সিতে সে নিয়মিত রোগী দেখত।-জনকন্ঠ