করোনাভাইরাস: লকডাউন মানা কতটা জরুরি

8

– আবু সুফিয়ান

প্রাণঘাতী মহামারী করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) বর্তমানে সারাবিশ্বে এক ভয়ংকর অণুজীবের নাম। যে অণুজীব কোনো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সীমানা মানে না। সম্প্রতি এই ভাইরাস তরতর করে ছড়িয়ে পড়ার সাথে প্রাসঙ্গিক কতগুলো বহুল ব্যবহৃত শব্দ যেমন- লকডাউন, শাটডাউন, কোয়ারেন্টাইন, হোম কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশনের মত শব্দ আমরা প্রতিনিয়ত শুনে থাকি। এ শব্দগুলোর মধ্যে অন্যতম আলোচিত একটি হলো লকডাউন। আমি এখানে লকডাউন বিষয়ে তুলে ধরার কিছুটা চেষ্টা করবো। আগেই বলে নেয়া ভালো যে, লকডাউন স্থান-কাল পরিস্থিতি বুঝে বিভিন্ন ধরণের হয়। যেমন- কোন ভবনের ক্ষেত্রে যদি বলা হয় এই ভবনটি লকডাউন তবে এর দ্ধারা বুঝে নিতে হবে এই ভবনের বাইরের দিকের দরজাগুলি লক করা আছে। আপনি চাইলেও বাহিরে যেতে পারবেন না। এক্ষেত্রে বিষয়টি এমন নয় যে ভবনের ভেতরের মানুষগুলো অনিরাপদ। বরং তাদেরকে সামগ্রিকভাবে রক্ষা করার জন্যই ভবনটি লকডাউন করা হয়েছে।

বর্তমানে দেশব্যাপী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যেধরনের লকডাউন চলছে সেটা হলো সম্পূর্ণ লকডাউন। এর মানে হলো যে যেখানেই থাকুন না কেন সে সেখানেই থাকতে হবে অর্থাৎ প্রয়োজন ছাড়া বাহিরে একদমই বের হওয়া যাবে না। এমন পরিস্থিতিতে ইসলামী শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস হাদিসের কিতাবগুলোর মধ্যে সবথেকে বিশুদ্ধ গ্রন্থ সহীহ আল বুখারির ৫৭৩০ নং হাদিসে বলা হয়েছে, আবদুল্লাহ ইবনে আমের (রা.) হতে বর্ণিত, একদিন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.) সিরিয়ায় যাওয়ার জন্য বের হয়ে সারগ নামক স্থানে পৌঁছালে আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) তাকে খবর দিলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন তোমরা কোন এলাকায় মহামারীর পাদুর্ভাবের কথা শোন, তখন সে এলাকায় প্রবেশ করো না। আর যদি তোমরা মহামারী আক্রান্ত এলাকায় অবস্থান কর, তাহলে পলায়নের উদ্দেশে সেখান থেকে বেরিয়ে যেও না। দু:খের বিষয় মহামারীর এমন পরিস্থিতিতে লকডাউনের সময় যেখানে মসজিদে নামাজ আদায়ে লোকসমাগম সীমিত করা হয়েছে, সেখানে গত শনিবার খেলাফত মজলিস নেতা যোবায়ের আনসারীর জানাজায় সরকার ঘোষিত লকডাউনকে উপেক্ষা করে লাখো জনতা অংশগ্রহণ করে।

জানাযায় অংশগ্রহণ একটি পূণ্যের কাজ এটি দিবালোকের ন্যায় সত্য। তবে বিষয় হচ্ছে জানাযা আদায় করা ফরজে কিফায়াহ অর্থাৎ অনেকের মধ্য থেকে কয়েকজন বা কেউ কেউ আদায় করলে হক পরিপূর্ণ হয়ে যায়। হাদিসের এমন ভাষ্য জানার পরও মনে হচ্ছে আমরা জাতি হিসেবে একটু বেশি আবেগপ্রবণ!

বিষয়টি আরো সুষ্পষ্টভাবে জানুন, সহীহ আল বুখারীর ৫৭৭৪ নং হাদীসে এসেছে, আবু সালমা(রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবু হোরায়রা (রা.) (সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবি ও আহলে সুফফার অন্যতম সদস্য) কে বলতে শুনেছি, নবী করিম (সা.) বলেছেন, তোমরা কোন রোগাক্রান্তকে সুস্থের সংগে রাখিও না।

এ হাদিস থেকে সুষ্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, মহামারীর মত কঠিন পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন রক্ষায় লকডাউন, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন এবং হোম কোয়ারেন্টাইন এর মতো কঠিন ও অনূকুল সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন। তারপরও আমরা কেন ধর্মান্ধতার মধ্যে আজ নিমজ্জিত? সম্প্রতি মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠাতা ও বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনকুবের বিল গেটস তার এক করোনাভাইরাস বিষয়ক প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছেন, লকডাউন এর মতো কঠিন সিদ্ধান্ত যে দেশ যত দ্রুত নিয়ে সেটি মানতে পারবে, সে দেশে ততো পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

আশ্চর্যের বিষয় হলো জাতি হিসেবে আমরা কোন বিষয়ে জানলেও সেটা মানার চেষ্টা করি কম। যেকারণে আজ আমাদের দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা এক এক করে প্রায় শত’র কাছাকাছি। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যাও।

সর্বোপরি, আমি মনে করি, বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে এবং এটিই হওয়ার কথা। সত্যি কথা বলতে মাছ যেমন পানি ছাড়া বাঁচতে পারে না তেমনি মানুষও পানির ভেতর বেঁচে থাকতে পারে না। আর করোনাভাইরাস এমন একধরণের ভয়ংকর ভাইরাস যাতে কেউ আক্রান্ত হলে তার শ্বাসকষ্ট এতো বেশি পরিমাণ বেড়ে যায় যেন সে গভীর পানিতে ডুবে আছে। গভীর পানির মধ্যে যেমন নিশ্বাস নিলেই নিশ্চিত মরতে হবে। সেসময় জীবন বাঁচানোই বড় চ্যালেঞ্জ। এটা জেনেও ওই কঠিন পরিস্থিতিতে বেহুশ হওয়া যাবে না বাঁচার জন্য আমৃত্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়, তেমনি প্রাণঘাতী এ করোনাভাইরাসের প্রতিরোধে সম্মিলিত চেষ্টার ফলেই এই ভাইরাসকে নির্মূল করা সম্ভব।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক খুলনাঞ্চল-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)