এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ…/ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা…

177
Spread the love





বিশেষ প্রতিনিধি:

ওই বুঝি কালবৈশাখী/ সন্ধ্যা-আকাশ দেয় ঢাকি…। হ্যাঁ, এবার বৈশাখেই কালবৈশাখীর ভয়। জরাগ্রস্ত পৃথিবী। বাংলাদেশও শঙ্কায়। এ অবস্থায় যেন নতুন স্বপ্ন নিয়ে এসেছে বাংলা নববর্ষ। আজ মঙ্গলবার ১৪২৭ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। বাঙালীর পহেলা বৈশাখ। বাঙালীর প্রধান অসাম্প্রদায়িক উৎসব। বাজেনি নাকাড়া, নহবৎ ধ্বনি, সানাই অথবা শাঁখ/ তবু এসে গেছে নব পল্লবে, নব উৎসবে,/নব জীবনের নব অনুভবে, এপ্রিলে বৈশাখ…। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এবার বৈশাখ কিছুটা বিবর্ণ। উৎসবহীন। হাসিরাশি আনন্দ বলা চলে উধাও। তবুও সময় বয়ে যায়। পুরনোকে পেছনে ফেলে আসে নতুন। সেই নতুনকে লোক আচার, অসাম্প্রদায়িক চেতনার উজ্জ্বল আলোয় বরণ করে নেবে বাঙালী।

আজ পুরনো দিনের শোক-তাপ-বেদনা-অপ্রাপ্তি-আক্ষেপ ভুলে অপার সম্ভাবনার দিকে, স্বপ্নের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়ার দিন। সকল ভয়কে জয় করার মানসে নতুন করে জেগে ওঠার উপযুক্ত সময়। কবিগুরুর ভাষায় : নব আনন্দে জাগো আজি নব রবি কিরণে/শুভ্র সুন্দর প্রীতি-উজ্জ্বল নির্মল জীবনে…। একই আনন্দের বহির্প্রকাশ ঘটিয়ে নজরুল লিখেছেন: তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়/তোরা সব জয়ধ্বনি কর…।

অবশ্য জয়ধ্বনি করার কথা কবি বললেও, এবার ভিন্ন বাস্তবতা। প্রকৃতি বড় রুষ্ঠ। করোনার প্রাদুর্ভাবে পর্যুদস্ত পৃথিবী। সদা দাপিয়ে বেড়ানো মানুষ ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়েছে। পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ নেই। একে অন্যের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে চলেছে শুধু। এ অবস্থায় আজ বর্ষ শুরুর দিনে সামাজিক দূরত্ব মেনে নিয়েও, মানসিকভাবে পরস্পরের কাছে থাকার শপথ নেবে বাঙালী।

রমনার বটমূলে যাওয়া হবে না। ছায়ানটের শিল্পীদের সঙ্গে গান গাওয়া হবে না। আয়োজন করা হবে না মঙ্গল শোভাযাত্রার। তবে বাঙালী তার মনের রংটুকু ধরে রাখবে। হতাশায় না ডুবে সবাই মিলে একসঙ্গে বাঁচার স্বপ্ন দেখবে। ভবিষ্যতে আরও সুন্দর আরও বর্ণাঢ্য নববর্ষ উদ্যাপনের স্বার্থেই এবার ঘরে বসে নিজেদের মতো করে উদ্যাপন করবে বাঙালী।

বর্ষ শুরুর দিনে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আবহমান কাল ধরেই চলছে বৈশাখ বরণের আনুষ্ঠানিকতা। প্রকৃত রূপটি দৃশ্যমান হয় গ্রামে। এক সময় গ্রামবাংলায় চৈত্রসংক্রান্তি ছিল প্রধান উৎসব। বছরের শেষ দিনে তেতো খাবার খেয়ে শরীর শুদ্ধ করতেন কৃষাণ-কৃষাণীরা। নির্মল চিত্তে প্রস্তুত হতেন নতুন বছরে প্রবেশ করার জন্য। এখনও বৈশাখ বরণের অংশ হিসেবে বাড়িঘর ধুয়েমুছে পরিষ্কার করেন গৃহিণীরা। অদ্ভুত মুন্সিয়ানায় আল্পনা আঁকেন মাটির মেঝেতে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠবেন সবাই। স্নান সারেন। নতুন পোশাক পরেন। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে বেড়াতে যান। ঘরে ঘরে সাধ্যমতো বিশেষ খাবার রান্না করা হয়। থাকে পিঠা-পুলির আয়োজন। নববর্ষ উপলক্ষে হাটে-মাঠে-ঘাটে ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়। নানা রকম কুটির শিল্প, খেলনা, মিষ্টিসহ বাহারি পণ্যে সাজানো হয় স্টল। থাকে নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা কিংবা কুস্তির মতো ঐতিহ্যবাহী আয়োজনও।

নাগরিক জীবনেও বিপুল আনন্দ যোগ করে পহেলা বৈশাখ। বর্ষবরণের দিন সব শহরেই আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য উৎসব অনুষ্ঠানের। ধর্ম বর্ণ ভেদ ভুলে অসাম্প্রদায়িক উৎসবে মাতে বাংলা। ষাটের দশকে বাঙালী চেতনাবিরোধী অবস্থানের প্রতিবাদে রাজধানী শহর ঢাকার রমনা বটমূলে শুরু হয় বৈশাখ উদ্যাপন। এর মাধ্যমে বাঙালী আপন পরিচয়ে সামনে আসার সুযোগ পায়। পরবর্তী সময়ে বাঙালীর রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উত্থান ঘটে পহেলা বৈশাখের। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিবসটি বর্তমানে বাঙালীর জাতিসত্তায়, চেতনায় ও অনুভবের জগতে গভীরভাবে বিরাজ করছে।

এ প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মদ এনামুল হকের বলাটি চমৎকার। তিনি বলেছেন, আমাদের অধুনাতম নববর্ষ এদেশের গ্রীষ্মকালীন উৎসব ও কৃষি উৎসব উদযাপনের একটি বিবর্তিত নবসংস্করণ। এর অতিহ্য প্রাচীন কিন্তু রূপ নতুন, নতুন সংস্কার, নতুন সংস্কৃতি, নতুন চিন্তাধারা অবারিত স্রোতে যুক্ত হয়ে সৃষ্টি করেছে এমন এক নতুন আবহ যাকে একটা দার্শনিক পরিম-ল বলে উল্লেখ করতে হয়। এ পরিম-লে পুরাতন বিলীন জীর্ণ স্তূপ নিশ্চিহ্ন, মিথ্যা বিলুপ্ত ও অসত্য অদৃশ্য। আর নতুন আবির্ভূত নবজীবন জাগরিত সুন্দর সম্মিত ও মঙ্গল সম্ভাবিত কালবৈশাখীই এর প্রতীক। সে নববর্ষের অমোঘ সহচর। নবসৃষ্টির অগ্রদূত সুন্দরের অগ্রপথিক ও বিজয়কেতন।