করোনাভাইরাস: জীবন না জীবিকা?

7
Spread the love

–  চিররঞ্জন সরকার

চলমান কোভিড-১৯ সংকটে করণীয় নিয়ে সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যমে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ দম্পতি অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলোর আলাপচারিতা প্রকাশিত হয়েছে। এখনকার সব চাইতে বড়, সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা কী? এ প্রশ্নের উত্তরে তারা একমত হয়েছেন যে, ‘এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মানুষের জীবন বাঁচানো, অদূর ভবিষ্যতে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে তাদের কাজে ফেরানো। তার পরবর্তী সময়ের সমস্যা- স্বাভাবিক অর্থনীতিতে ফিরে যাওয়া। আজ আমরা প্রাণ বাঁচাতে যা করছি, তার পরিণাম বড় হতে হতে যেন ভবিষ্যতে জীবিকা হারানোর কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, তা দেখতে হবে।’ আসলে বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণ করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এখন সব দেশের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত অবশ্যই মানুষের জীবন বাঁচানো। কারণ মানুষের জীবনের চেয়ে বড় কিছু নেই। সেই জীবন এখন করোনাভাইরাসের কারণে বিপন্ন। যতটা সম্ভব নিজেকে একা রাখা, সঙ্গ বর্জন করা, বার বার হাত ধোয়া, স্বাস্থ্যবিধি মেনা চলাই সবচেয়ে বড় কর্তব্য। যাতে সংক্রমিত লোকের সংস্পর্শে এসে রোগ না ছড়ায়। পাশাপাশি যাদের মধ্যে করোনার লক্ষণ প্রকাশ পাবে, তাদের দ্রুত পরীক্ষা করানো এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মুহূর্তে আমাদের চিকিৎসকের কথা শুনতে হবে। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। কারণ এর বাইরে কারও হাতে নিরাময়ের অন্য কোনো উপায় নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিরাময়ের উপায় খোঁজার চেষ্টা চলছে, কিন্তু তা পেতে আরও সময় লাগবে। এখন আমাদের কাছে একটাই উপায়, নিজেদের আলাদা রাখা।

তবে বর্তমান পরিস্থিতি যদি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে তাহলে বড় ধরনের দুর্যোগ নেমে আসবে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে একটা অস্বাভাবিক জীবন যাপন করা মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। মানুষ কাজ করছে না, রোজগার বন্ধ, বাইরে বেরোচ্ছে না, প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছে না। এ এক কঠিন পরিস্থিতি। সব কিছু বন্ধ রেখে মানুষকে ঘরের মধ্যে রাখতে পারলে কিছু কম লোক মারা যেতে পারে। আবার অন্য দিকে, দীর্ঘদিন বাড়িতে বসে থাকার, সব কিছু বন্ধ রাখার একটা আলাদা চাপ আছে। এটা অনেকদিন বহাল রাখলে পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হবে। করোনা এখনও আমাদের কাছে কিন্তু অপার রহস্য। ইদানীংকার গবেষণা বলেছে, অনেক সংক্রমিত লোকের মধ্যে কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এটা যদি বেশি বেশি হয়, তাহলে সমষ্টিগত প্রতিরোধক্ষমতা থেকে অনেক দূরে যাব আমরা। এই রোগের লক্ষণ, চরিত্র এসব নিয়েও এখনও স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। সংক্রমিত মানুষদের মধ্যে মৃত্যুহার নিয়েও রয়েছে অনেক বিতর্ক। মৃত্যুহার দেশ থেকে দেশে অনেকটা তফাত হয়ে যায়। ইউরোপের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, সুইডেনে মৃত্যুহার মাত্র ০.৫ শতাংশ, আবার ইটালিতে ১০ শতাংশ। কেন এই তফাত হচ্ছে, তা স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে। সংক্রমণের হার গণনাতেও রয়েছে ফাঁক-ফোকর। সুইডেনে নমুনা পরীক্ষার দ্বারা গোটা জনসংখ্যায় সংক্রমণের হার পরীক্ষা করা হচ্ছে, যেখানে ইটালিতে যারা হাসপাতালে আসছেন, কেবল তাদেরই পরীক্ষা করা হচ্ছে। তাই এমন হতে পারে যে, ইটালিতে অধিক অসুস্থদের বেশি পরীক্ষার জন্য জনসংখ্যায় সংক্রমণে মৃত্যুহার বেশি আসছে। আবার এমনও হতে পারে যে, এই মৃত্যুহার ইটালিতে দুর্বল চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতিফলন, অসুস্থদের চিকিৎসা ভালো হচ্ছে না বলে মৃত্যুহার বেশি হচ্ছে। এই ধারণার মূলে কিছু সত্য আছেÍ ইটালিতে যথেষ্ট হাসপাতাল বা বেড নেই।

তবে আমরা বাস করছি চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। অনেকের ধারণা, যখন গরম পড়বে, আর্দ্রতা বাড়বে, তখন অসুখ অন্য কোনো দিকে মোড় নিতে পারে। তবে এটা যে হবেই-এর কোনো বাস্তব পর্যবেক্ষণ নেই। নতুন ভাইরাস, এর সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। তবে নানা দিক থেকে আমাদের দেশ হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ। এখানকার জনসংখ্যার ঘনত্ব, অনেকের ডায়াবেটিস, হাঁপানি, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি উপসর্গ রয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জীবনযাত্রার পার্থক্য রয়েছে। আমাদের দেশে ভেজাল ও দূষণের প্রভাব রয়েছে। এগুলোতে ফুসফুসের ক্ষতি হয়, তা সমস্যাকে আরও বাড়ায়। তাই এখানে কেউ স্পষ্ট করে জানে না এই সব কিছুর কী প্রভাব পড়বে। আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা অত্যন্ত অপ্রতুল। ডাক্তারদের কোভিড চেনা এবং এ ধরনের রোগের চিকিৎসা দেওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। হাসপাতালে বেড নেই, পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর নেই। চিকিৎসকদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা-সরঞ্জাম নেই।

এ মুহূর্তে দরকার একটা তথ্যব্যাংক গড়ে তোলা, তথ্য বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন তৈরি। কোথায় সংক্রমণের কেন্দ্র, কোথায় রোগের বিস্ফোরণ হতে পারে, সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা। এসব তথ্যের ভিত্তিতে কোন জায়গাগুলো বেশি আক্রান্ত, আর কোনগুলোতে এখনও সংক্রামিত রোগী নেই, কিন্তু হতে পারে, সেগুলো নির্ণয় করা যেতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করা গেলে সেখানে জরুরি ভিত্তিতে একটা চিকিৎসক দল সরঞ্জাম-সহ তাৎক্ষণিকভাবে প্রেরণ করা যেতে পারে। সেখানে ভেন্টিলেটরও সরবরাহ করা যায়। অপ্রতুল চিকিৎসাসেবার এই দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে কীভাবে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়-সেই চেষ্টা করা দরকার। তবে করোনা থেকে জীবন বাঁচানোর এই সংগ্রাম শেষ হলে অদূর ভবিষ্যতে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে মানুষজনকে তাদের কাজে ফেরানো, স্বাভাবিক অর্থনীতিতে ফিরে যাওয়া। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো দম্পতিও সেই বিষয়টাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। তারা বলেছেন, আজ আমরা প্রাণ বাঁচাতে যা করছি, তার পরিণাম বড় হতে হতে যেন ভবিষ্যতে জীবিকা হারানোর কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। ইতিমধ্যে মানুষের জীবন আর জীবিকায় একটা সংঘাত হচ্ছে। এ মুহূর্তে কৌশলকে আরও সূচারু করতে হবে। রোগের প্রধান কেন্দ্রগুলো চিহ্নিত করা এর শ্রেষ্ঠ উপায় হতে পারে। একথা ঠিক করোনার স্থায়ীত্ব যতদিনই হোক না কেন, এর ফলে আমাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের উপর সীমাহীন প্রভাব পড়বে। বিশ্ব অর্থনীতির পতন হবে। ধনী দেশগুলো বাইরে থেকে কেনা বন্ধ করে দেবে। এটা মোটামুটি পরিষ্কার। আমরা এক বিপুল মন্দার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি।

অনেকে বলছেন, না, খুব একটা মন্দা হবে না। ধনী তো তার আয় হারাচ্ছে না, মধ্যবিত্ত বাড়ি হারাচ্ছে না, কিছু দিন একটু কমতি যাবে তারপর লোকে আবার কেনা শুরু করবে। যদিও এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমশ কমছে। শেয়ার বাজারে ধস নেমেছে। মধ্যবিত্তের আয় কমেছে। এই সময়ের পরে ক্রেতারা উৎসাহের সঙ্গে জিনিসপত্র কিনবে, তার আশা কম। তাই প্রয়োজন এমন নীতি যা এই ব্যবস্থাটাকে চালু রাখবে। চাহিদাকে ফের চাঙ্গা করবে। কারণ মানুষের আয় এত কমবে, এত সম্পদ তারা হারাবে, যে হাতে যা আছে তা তারা খরচ করতে চাইবে না। হাতে রেখে দিতে চাইবে। এ ব্যাপারে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো দম্পতির কয়েকটি প্রস্তাব রয়েছে। এগুলো আমরাও বিবেচনা করে দেখতে পারি। প্রথমত, এমনভাবে করোনা-সচেতনতার প্রচার চালাতে হবে যাতে প্রতিটি পরিবারের অন্তত এক জন সদস্য এ নিয়ে ওয়াকিবহাল থাকেন।

দ্বিতীয়ত, সংক্রমণ হবেই, এটা ধরে নিয়ে লক্ষ রাখতে হবে, যাতে করোনা-আক্রান্ত ব্যক্তি কোনওভাবেই সামাজিকভাবে একঘরে না হয়ে যান বা তা লুকিয়ে না রাখেন।

তৃতীয়ত, সরকারের উচিত বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে এই ভাইরাসে আক্রান্তদের বিষয়টি নজরে আনা।

চতুর্থত, গ্রামীণ এলাকার স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তরাই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে রিপোর্ট করতে পারেন।

পঞ্চমত, করোনা সংক্রান্ত রিপোর্ট যাতে দ্রুত এবং দক্ষতার সঙ্গে একত্র করা যায়, তা-ও খেয়াল রাখতে হবে। যা দেশ জুড়ে করোনা-বিষয়ক পরিসংখ্যানের লেখচিত্র (গ্রাফ) তৈরিতে সহায়তা করবে।

ষষ্ঠত, চিকিৎসক, নার্স-সহ স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি ভ্রাম্যমাণ টিম তৈরি করতে হবে। যাদের হাতে পরীক্ষার সরঞ্জাম থাকবে।

সপ্তমত, এই টিম যাতে সমস্ত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ব্যবহার বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো সদ্ব্যবহারের সুযোগ পায়, এমন ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।

অষ্টমত, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলির সুবিধা যাতে অর্থনৈতিক ভাবে অনগ্রসরেরা পান, তা দেখা উচিত সরকারের। এর ফলে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময়ে তা কাজে আসবে।

পরিশেষে, করোনার প্রতিষেধক না পাওয়া পর্যন্ত সরকারের এই ‘যুদ্ধকালীন তৎপরতা’ চালিয়ে যেতে হবে। প্রতিষেধক মিললেও স্বাস্থ্য পরিকাঠামো শক্তিশালী করার কাজ করে যেতে হবে।

 (এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক খুলনাঞ্চল -এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)