শিশু হত্যার অভিযোগ যখন মায়ের বিরুদ্ধেই!

6

মামুন খান :

রাজধানীতে একের পর এক শিশু হত্যাকা-ের লোমহর্ষক ঘটনা ঘটছে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য ও আতঙ্কের বিষয় হলো এসব হত্যাকা-ের বেশিরভাগেরই অভিযোগের তীর মায়েদের দিকে। যে মায়ের কোলে সন্তান সবচেয়ে নিরাপদ থাকার কথা, তার হাতে নির্মমতার শিকার হয়েছ এ শিশুরা।

ইতোমধ্যে এ ধরনের হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েকজন মা দাঁড়িয়েছেন আদালতের কাঠগড়ায়। তাদের বিচারও চলছে। সামাজিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, পর পুরুষের প্রতি আসক্তিই তাদের এমন নিষ্ঠুর আচরণ করতে প্রলুব্ধ করেছে। সেই সব ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে এ প্রতিবেদনে।

শিশু শামিউল হত্যা: পরকীয়া প্রেমিক শামসুজ্জামান আরিফ ওরফে বাক্কুর সঙ্গে মা আয়েশা হুমায়রা এশার অনৈতিক সম্পর্কের কোনো ঘটনা দেখে ফেলায় ২০১০ সালের ২৩ জুন শামিউলকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। এরপর লাশ গুম করতে ঢোকানো হয় ফ্রিজে। পরদিন লাশটি বস্তায় ঢুকিয়ে ফেলে দেওয়া হয় রাস্তায়। ঘটনার পর শামিউলের বাবা কে আর আজম (৪২) আদাবর থানায় হত্যা ও লাশ গুমের অভিযোগে এশা এবং বাক্কুর বিরুদ্ধে মামলা করেন। বাক্কু ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন। মামলাটি তদন্ত করে আদাবর থানার ওসি কাজী শাহান হক ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর দুই জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।

মামলাটি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলমের আদালতে বিচারাধীন। এ মামলায় গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। একই বছরের ২০ অক্টোবর এশা আদালতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। এরপর গত ৫ মাসে ৫টি ধার্য তারিখ পার হলেও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন হয়নি। আগামী ৫ এপ্রিল মামলাটি যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।

মামলা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আদালতের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর ফারুক উজ-জামান ভূঁইয়া (টিপু) বলেন, সম্প্রতি আসামি এশা তার আইনজীবী পরিবর্তন করেছেন। এজন্য একটু সময় লাগছে। ৫ এপ্রিল যুক্তিতর্ক শেষ হয়ে গেলে ৮/১০দিনের মধ্যে মামলাটির রায় হয়ে যাবে বলে আশা করছি। তিনি বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছি। আশা করছি আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা হবে।

শামিউল রাজধানীর মোহাম্মদপুর নবোদয় হাউজিংয়ে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ইংলিশ মিডিয়ামে প্লে-গ্রুপের ছাত্র ছিল।

বনশ্রীতে নুসরাত আমান ও আলভী হত্যা: রামপুরার বনশ্রীর ৪ নম্বর রোডের ৯ নম্বর বাসায় ২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে দুই ভাইবোনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। স্বজনদের দাবি ছিল, রেস্তোরাঁর খাবার খেয়ে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। দুই সন্তানের মরদেহ মর্গে রেখে মা-বাবার গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ায় এবং মামলা না করায় এ ঘটনা নিয়ে রহস্য ঘনীভূত হয়। এরপর লাশের ময়নাতদন্তে দুই শিশুকে শ্বাসরোধে হত্যার আলামত পান চিকিৎসকরা।

এ ঘটনায় মাহফুজার স্বামী আমান উল্লাহ বাদী হয়ে ২০১৬ সালের ৩ মার্চ তার স্ত্রী মাহফুজা মালেককে একমাত্র আসামি করে রামপুরা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করে ২০১৬ সালের ১৬ জুন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক লোকমান হাকিম মাহফুজা মালেককে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন। পরের বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি মাহফুজার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। মামলাটি ঢাকা মহানগর ৪র্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মাকছুদা পারভীনের আদালতে বিচারাধীন। আগামী ১২ এপ্রিল মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। এখন পর্যন্ত ৩৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ২০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে।

মামলা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর সাইফুল ইসলাম হেলাল বলেন, সাক্ষ্যগ্রহণ প্রায় শেষ পর্যায়ে। কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়েই সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হবে। যত দ্রুত সম্ভব রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলাটির বিচারকাজ শেষ করার চেষ্টা করবো। আমরা আশা করছি জুন মাস নাগাদ বিচার শেষ হবে।

তিনি বলেন, আসামি বাচ্চাদের মা হতে পারেন। কিন্তু তাকে খুন করার অনুমতি কেউ দেননি। আমরা আশা করছি তার সর্বোচ্চ সাজা হবে। নুসরাত ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের (প্রধান শাখা) পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তো। হলি ক্রিসেন্ট (ইন্টারন্যাশনাল) স্কুল অ্যান্ড কলেজের নার্সারিতে পড়তো আলভী।

শিশু নিহাল হত্যা: বনশ্রীতে মায়ের হাতে নুসরাত-আলভী খুন হওয়ার রেশ কাটতে না কাটতেই ওই বছরের ১৮ এপ্রিল উত্তরখানে মাস্টারপাড়া সোসাইটির একটি বাসায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে দেড় বছরের শিশু নিহাল সাদিককে হত্যা করে মা মাহমিদা মীর মুক্তি। শিশুটির বাবা সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন মুরাদ মুক্তিকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। নিহালকে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন মা মুক্তি। বিচ্ছেদের হুমকি ও স্বামীর সঙ্গে কলহের জেরে সন্তান হত্যার পর মুক্তি নিজে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন বলে দাবি করেন তিনি। মামলাটিতে পুলিশ চার্জশিট দাখিল করেছে। বর্তমানে বিচারাধীন।

নবজাতক হত্যা: গত বছরের ২২ ডিসেম্বর মোহাম্মদপুর থানার রায়েরবাজার এলাকার মোকাব খান রোডের ডাস্টবিনে এক নবজাতক ছেলের লাশ পাওয়া যায়। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত করে। এ ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়। মৃত নবজাতকের পরিচয় শনাক্ত করতে ২৪ ডিসেম্বর মৃত নবজাতকের মা সন্দেহে নার্গিসকে আটক করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে নার্গিস জানান, প্রেম করে শামীমকে বিয়ে করেন তিনি। পরে জানতে পারেন, শামীমের আরো তিনজন স্ত্রী আছে। ইতোমধ্যে গর্ভবতী হন নার্গিস। এ তথ্য শামীমকে জানালে, মা ও সন্তানকে খুন করার হুমকি দেন তিনি।

এরপর গত ২০ ডিসেম্বর বিকেলে প্রসববেদনা উঠলে টয়লেটে গিয়ে একা একা বাচ্চা প্রসব করেন নার্গিস। বাচ্চাটির গলা টিপে মেরে লাশ গোপন করার জন্য পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দেন।

নবজাতককে খুনের ঘটনায় ২৬ জানুয়ারি মোহাম্মদপুর থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) অপূর্ব কুমার বর্মণ বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ডাস্টবিন থেকে পাওয়া নবজাতকের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য আলামত পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠানো হয়। ফরেনসিক প্রতিবেদনে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ওই নবজাতকের মা নার্গিস। মামলাটি তদন্তাধীন।

মেহেজাবিন আলফি ও ফেরদৌস: স্ত্রী-দুই মেয়েকে মাসে খরচ দিতো ১১শ টাকা। আর সব খরচ শ্বশুর-শাশুড়ির পেছনেই করতো স্বামী। এ ধারণা ছিল স্ত্রী আক্তারুন্নেছা পপির। আর তার এ ধারণার খেসারত দিতে হয়েছে দুই মেয়েকে জীবন দিয়ে। আর স্বামী বলছে, পর্যাপ্ত খরচই তাদের দেওয়া হতো। গত ৬ মার্চ রাত আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে দক্ষিণ গোড়ানে ঘুমন্ত দুই শিশু জান্নাতুল ফেরদৌস ও মেহেজাবিন আলভীকে প্রথমে আগুনে পুড়িয়ে এবং পরে বটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে মা পপি। এরপর নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে।

এ ঘটনায় ৮ মার্চ স্ত্রী আক্তারুন্নেছা পপিকে আসামি করে খিলগাঁও থানায় মামলা দায়ের করেন স্বামী মোজাম্মেল হোসেন বিপ্লব। মামলাটি খিলগাঁও থানা পুলিশ তদন্ত করছে। আর আসামি পপি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন।

মোজাম্মেল হোসেন বিপ্লব বলেন, ব্যবসায়িক কারণে গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে থাকি। প্রতি বৃহস্পতিবার ঢাকায় এসে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে থাকতাম। আমার স্ত্রী দুই মেয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস ছিল। আর সে আমাকে আমার বাবা-মা থেকে আলাদা থাকতে বলতো। এটা কি সম্ভব। যা হোক, আমি তাদের নিয়মিত টাকা পাঠাতাম। তাদের জন্য মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পাঠাতাম। দুই বাচ্চাকে মেরে ফেলার পর আমার স্ত্রী বলেছে, তাদের মাসে ১১শ টাকা দিতাম। ঘটনার দিন শুক্রবারও তাকে ১৫শ টাকা দিয়েছি। আর বলেছিলাম দুইদিন পর আবার টাকা পাঠাবো। ওর যে বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছি তা চেক করলেই বোঝা যাবে ওকে আমি মাসে কত টাকা খরচের জন্য দিতাম। ও যা বলছে তা মিথ্যা।

তিনি বলেন, ব্যবসায়িক কারণে ৪০ লাখ টাকা ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ি। এছাড়া ২২ লাখ টাকা মূল্যের একটি জমিও কিনেছি। টাকা পরিশোধ হওয়ার পরও জমির মালিক তাদের ওই জমি তাকে রেজিস্ট্রি করে দেননি। আমার স্ত্রী আমার কাছে, দলিল দেখতে চাই। কিন্তু তাকে আমি দেখাতে পারিনি। একারণে সে রাগ করে। ভাবে আমি মিথ্যা বলছি। আর সে আমার ফ্যামিলির সঙ্গে মিশতে দিতে চাইতো না।

বিপ্লব বলেন, ১৪ বছর আমাদের বিয়ে হয়েছে। তারা একটা অভিযোগ দেখাক যে আমি অন্যায় করেছি। অথচ তারা এখন বলছে আমি তাদের কাছে যৌতুক চেয়েছি। এটা তারা আমার স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য বলছে। আমাদের বিয়ের চার বছর পর প্রথম মেয়ের জন্ম। এতদিনে আমি আমার মেয়েদের গাঁয়ে ফুলের টোকাও দেয়নি। আর সে আমার দুই মেয়েকে এত কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলেছে। আমি তার যাবজ্জীবন সাজা চাই। মৃত্যুদ- হলে তো একদিনেই শেষ হয়ে যাবে। ওর যাবজ্জীবন সাজা হোক। ও জেলে বসে শাস্তি পেতে পেয়ে বুঝুক, ও কি অন্যায় করেছে। এবিষয়ে পপির বাবা আবু তালেবের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কিছু বলতে রাজী হননি। তিনি বলেন, যা বলার তা তো আগেই মিডিয়াকে বলে দিয়েছি। এখন আর কিছু বলতে চাই না।

এ সম্পর্কে আইনজীবী ও সাংবাদিক সৈয়দা ফরিদা ইয়াসমিন জেসী বলেন, একজন মা কীভাবে তার সন্তানকে খুন করার কথা চিন্তা করতে পারে। শত কষ্টের পর সন্তানের মুখের দিকে তাকালে সব কষ্ট ভুলে যায়। কিছু মা আছেন অতিরিক্ত মোহে পড়ে সন্তানদের খুন করেন। এ ধরনের মায়েদের সর্বোচ্চ সাজা হওয়া উচিত। যাতে করে পরবর্তী সময়ে কেউ এধরনের কাজ করার সাহস না পায়।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহিত কামাল বলেন, যে মা সন্তানদের খুন করে, সে আর মা থাকে না। কোনো মা তার সন্তানকে খুন করতে পারে না। ধর্ম, বিজ্ঞান সেটাই বলে। তাহলে কে করে? একজন নারী শিশুকে খুন করে। কোন নারী? যে নারী মাতৃত্ব খুঁয়িয়েছে বা হারিয়েছে। কেন হারিয়েছে? সেটা নানা কারণে হতে পারে। রোগের কারণে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে, তখন তার মাতৃত্ব আর থাকে না, সে রোগী হয়ে যায়। সেই রোগী তার সন্তানকে খুন করতে পারে। সুতরাং মা সন্তানকে খুন করে এটা ভয়ঙ্কর। যখন পর পর কয়েকজন মা তাদের সন্তানদের তখন কয়েকটি পত্রিকাতে এলো, মা খুনি। আর তখন ঘরে ঘরে ভীতির সঞ্চার হলো। বাচ্চারা মায়েদের বলতে লাগলো, পড়াশোনা না করলে তুমি কি আমাকে খুন করবে, আতঙ্ক সঞ্চারিত হলো। কাজেই মা খুন করেছে এটা আমরা এড়িয়ে যেতে চাই।