ঢাকায় ৩ করোনা রোগী শনাক্ত, ২ জন কোয়ারেন্টাইনে: আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই

6
Spread the love

বিশেষ প্রতিনিধি

অবশেষে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে করোনাভাইরাস। দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিনজন রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং আরও দু’জনকে সন্দেহজনকভাবে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মীরজাদী সেব্রিনা ফোরা। তিনি বলেন, আক্রান্তদের হাসপাতালে রেখে লক্ষণ-উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। তারা বর্তমানে ভাল আছেন। এ মুহূর্তেই আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে প্রস্তুত রয়েছে বাংলাদেশ। রাস্তাঘাটে চলাফেরায় সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন তিনি। অধ্যাপক ডাঃ সেব্রিনা ফোরা আরও জানান, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিনজনের মধ্যে একজন নারী ও দুজন পুরুষ। তাদের মধ্যে দুজন ইতালিফেরত। আক্রান্ত নারী ইতালি প্রবাসী এক পুরুষের পরিবারের সদস্য। আক্রান্ত তিনজনের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।

রবিবার বিকেলে করোনাভাইরাস নিয়ে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে আইইডিসিআর’র পরিচালক এ তথ্য জানান। এ সময় আইইডিসিআর’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এএসএম আলমগীর উপস্থিত ছিলেন।

অধ্যাপক ডাঃ মীরজাদী সেব্রিনা ফোরা বলেন, শনিবার পরীক্ষায় তাদের সংক্রমণের বিষয়টি ধরা পড়ে। আক্রান্ত তিনজনকে হাসপাতালের আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। প্রবাসী দু’জন দেশে আসার পর তাদের শরীরে উপসর্গ দেখা দেয়। তারা আইইডিসিআর-এর হটলাইনে ফোন করলে ইনস্টিটিউটের র‌্যাপিড রেসপন্স টিম তাদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠায়। সেখানে দু’জনের শরীরে কোভিড-১৯ পজেটিভ পাওয়া যায়। এরপর তাদের সঙ্গে সংস্পর্শে থাকা চারজনকে পরীক্ষা করা হয়। যার মধ্যে আরও একজনের শরীরে ভাইরাসটির উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

আক্রান্ত তিনজন সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে অপরাগতা প্রকাশ করে অধ্যাপক ফোরা বলেন, রোগীদের নিরাপত্তার স্বার্থে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে রোগীদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করা যাবে না। তবে এ রোগ প্রতিরোধে দেশের সার্বিক প্রস্তুতি রয়েছে। তাই দেশবাসীকে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। আতঙ্কিত না হয়ে সাবধানতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক ডাঃ সেব্রিনা ফোরা বলেন, করোনাভাইরাসটি একজন মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মানুষের দেহে দ্রুত ছড়াতে পারে। করোনাভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বসতন্ত্রের মাধ্যমেই এটি একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছড়ায়। রোগটির লক্ষণ সম্পর্কে পরিচালক বলেন, জ¦র এবং কাশি থাকে। শ্বসকষ্ট এবং নিউমোনিয়ায় ভুগবে। দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া। ভাইরাসটি শরীরে ঢোকার পর সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিতে প্রায় পাঁচদিন লাগে। প্রথম লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। তারপর দেখা দেয় শুকনা কাশি। এক সপ্তাহের মধ্যে দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট। এই ভাইরাস থেকে প্রতিকার সম্পর্কে পরিচালক বলেন, যেহেতু এই ভাইরাসটি নতুন, তাই এর কোন টিকা বা ভ্যাকসিন এখনও নেই এবং চিকিৎসা ও লক্ষণ ভিত্তিক। প্রয়োজনে এই হটলাইন নম্বরে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেছে আইইডিসিআর। নম্বরগুলো হলো -০১৯২৭৭১১৭৮৪, ০১৯২৭৭১১৭৮৫, ০১৯৩৭০০০০১১ ও ০১৯৩৭১১০০১১।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে করণীয়: করোনাভাইরাসে আতঙ্কিত হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়নি বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআর’র পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মীরজাদী সেব্রিনা ফোরা। তবে ভাইরাসটি প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, নিয়মিত সাবান ও পানি দিয়ে দুই হাত ধোবেন (অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে)। অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করবেন না। ইতোমধ্যে আক্রান্ত এমন ব্যক্তিদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন। কাশি শিষ্টাচার মেনে চলুন (হাঁচি/কাশির সময় বাহু/টিস্যু/কাপড় দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখুন)। অসুস্থ পশু/পাখির সংস্পর্শ পরিহার করুন। মাছ-মাংস-ডিম ভালভাবে রান্না করে খাবেন। অসুস্থ হলে ঘরে থাকুন, বাইরে যাওয়া অত্যাবশ্যক হলে নাক-মুখ ঢাকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করুন। কারও সঙ্গে হাত মেলানো (হ্যান্ড শেক), কোলাকুলি থেকে বিরত থাকুন। জরুরী প্রয়োজন ব্যতীত বিদেশ ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকুন এবং এ সময়ে অন্য দেশ থেকে প্রয়োজন ব্যতীত বাংলাদেশ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করুন। অত্যাবশ্যকীয় ভ্রমণে সাবধানতা অবলম্বন করুন।

আক্রান্তদের অর্ধেকই সুস্থ হয়েছেন, বাকিরা চিকিৎসাধীন, মৃত্যুর হার ৩ শতাংশ: সিএনএন’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৬ হাজার জন আক্রান্ত হয়েছে। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬০০ জনে। এছাড়া এই ভাইরাসে আক্রান্ত ৬০ হাজার ১৯০ জন চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। বিশ্বব্যাপী ১০৩ দেশ ও অঞ্চলে এই ভাইরাসের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু চীনের মূল ভূ-খন্ডেই করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৮০ হাজার ৬৯৬ এবং মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ৯৭ জনের।

আক্রান্তদের ক্ষেত্রে শতকরা ৮২ ভাগই মাইল্ড কেস: ব্রিফিংয়ে আইইডিসিআর’র পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মীরজাদী সেব্রিনা ফোরা সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাস আক্রান্ত ১৭ হাজার রোগীর একটি বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে যে, এ ভাইরাসে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে শতকরা ৮২ ভাগই মাইল্ড কেস। এর বাইরে শতকরা ১৫ ভাগ সিভিয়ার কেস, যাদের রেসপিরেটরি ডিফিকাল্টি আছে। বাকি তিন ভাগ ক্রিটিক্যাল রোগী, যাদের আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) সাপোর্ট প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশ্লেষণ দেখেই এটা বোঝা যাচ্ছে যে, এন-করোনা ভাইরাস নিয়ে আমাদের মধ্যে যে আতঙ্ক আছে, এটা নিয়ে আসলে সে মাত্রায় আতঙ্কের কিছু নেই।

বেশিরভাগ কেসগুলোই খুব সাধারণ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে জানান, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। বাংলাদেশেও তিনজন করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে আতঙ্কিত না হয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে বাংলাদেশ। ভাইারাসটি মোকাবেলায় জাতীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তিন স্তরে কমিটি গঠন করা হয়েছে। জাতীয় কমিটির সভাপতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী, জেলা কমিটির প্রধান জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। প্রতিটি কমিটিতেই থাকবেন স্ব স্ব জেলার সিভিল সার্জন। দেশের হোটেলগুলোকে করোনা নিয়ে সতর্ক করা হয়েছে এবং তাদের করণীয় কী সেগুলো জানানো হয়েছে। স্থল, জল ও বিমানবন্দরসমূহে বাংলাদেশে আগত যাত্রীদের স্ক্রীনিং কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

কতটা ভয়ংকর এই ভাইরাস? চিকিৎসকরা বলছেন, শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য অসুস্থতার মতো করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রেও সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা এবং জ্বরসহ হালকা লক্ষণ দেখা দিতে পারে। কিছু মানুষের জন্য এই ভাইরাসের সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। এতে নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট এবং অর্গান বিপর্যয়ের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। যদিও খুব কম ক্ষেত্রেই এই রোগ মারাত্মক হয়। তবে এই ভাইরাস সংক্রমণের ফলে বয়স্ক ও আগে থেকে অসুস্থ ব্যক্তিদের মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

পঞ্চাশ ঊর্ধ্বদের সংক্রামণ, মৃত্যু ঝুঁকি বেশি: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরেই আমরা সচেতনতা তৈরি করেছি। এখন সেই সচেতনতা প্রকাশের পালা।  যাদের বয়স পঞ্চাশের বেশি, তাদের বিষয়ে বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিশ্বে করোনায় আক্রান্তদের অধিকাংশই বয়সে পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। আর তাদেরই মৃত্যু ঝুঁকি বেশি।’

‘‘আমাদের দেশের বয়স্কদের মধ্যে করোনা বিষয়ে প্রচারণা চালাতে হবে এবং তাদের সর্তক করতে হবে। পাশাপাশি আমাদেরও সতর্ক থাকতে হবে। জনসমাগম যুক্ত স্থান পরিহার করতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। সবচেয়ে প্রয়োজন আউটডোরে না থেকে ইনডোরে থাকা।’’

শিশুরা কি ঝুঁকিতে? ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, ‘যে কোনো বয়সের মানুষই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয়, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত কোনও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।’ ‘‘করোনা ভাইরাস কখনোই শিশু ও তরুণদের জন্য হুমকি নয়। দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ ৫০ বছর ঊর্ধ্বে যারা আছে, তারাই সংক্রামিত হচ্ছে এবং মৃত্যুও হচ্ছে তাদেরই। তবে শিশু ও তরুণরা যে আক্রান্ত হবে না- এমনটা নয়। পরিসংখ্যান বলছে, শিশু ও তরুণদের মৃত্যু ঝুঁকি নেই।’’

তিনি মনে করেন শিশুদের ও তরুণদের শরীরে এই ভাইরাসটা ক্ষতি করতে পারছে না। আবার আরেকটি কারণ হতে পারে বয়স্করা বিভিন্ন রোগে আগে থেকেই অসুস্থ থাকে। আর সেই সুযোগটা নিচ্ছে এই ভাইরাস।

করোনা থেকে বাঁচতে করণীয়: ১. আক্রান্ত ব্যক্তি হতে কমপক্ষে দুই হাত দূরে থাকতে হবে। ২. বারবার প্রয়োজন মতো সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা, বিশেষ করে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে কিংবা সংক্রমণস্থলে ভ্রমণ করলে। ৩. ভ্রমণের সময় কাশি শিষ্টাচার অনুশীলন করতে হবে (আক্রান্ত ব্যক্তি হতে দূরত্ব বজায় রাখা, হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখা, হাত ধোয়া, যেখানে-সেখানে কফ কাশি না ফেলা)। ৪. করমর্দন এবং কোলাকুলির মাধ্যমেও করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারে। তাই এই কাজ থেকেও বিরত থাকতে হবে। এছাড়াও করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে খাবার রান্না বা তৈরি করার আগে ও পরে, খাবার খাওয়ার আগে ও পরে, বাথরুম ব্যবহারের আগে ও পরে, বাইরে থেকে বাসায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই জীবাণুনাশক হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে অবশ্যই হাত ধুতে হবে।

জীবাণুনাশক কিনিং স্প্রে দিয়ে বাড়ি-ঘর ভালো মতো পরিষ্কার করাও জরুরি। বাসায় বক্সড টিস্যু, ভেজা টিস্যু, হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং পকেট টিস্যু ব্যবহার করে জীবাণুর আক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। এই বছরের শেষের দিকে চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস। এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে শতাধিক দেশের লক্ষাধিক মানুষ এতে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ। যার বেশির ভাগই চীনের। এছাড়াও সাউথ কোরিয়া, ইতালি ও ইরানের পরিস্থিতিও ভয়াবহ।