ঐতিহ্য অহংকারের রক্তসিক্ত দিন

9
Spread the love

মহান শহিদ দিবস ও আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষার জন্য বাঙালির গৌরবময় আন্দোলনের ৬৮ বছর পূর্ণ। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর তাদের ৩০তম সম্মেলনে ২৮টি দেশের সমর্থনে ফেব্রুয়ারির এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৮৮ দেশে একযোগে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

বিশেষ প্রতিনিধি::

‘আমার শহীদ ভাইয়ের আত্মা ডাকে/জাগে মানুষের সুপ্ত শক্তি, হাটে মাঠে ঘাটে বাঁকে/দারুণ ক্রোধের আগুনে জ্বালবো ফেব্রুয়ারি/একুশে ফেব্রুয়ারি, একুশে ফেব্রুয়ারি বরেণ্য সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ কবিতার শেষ ক’টি লাইনের মতোই শহীদ ভাইয়ের আত্মার ডাকে বাঙালির কোটি প্রাণ ভাই হারানোর শোকে মুহ্যমান। একই সঙ্গে দ্রোহের আগুনেও বলীয়ান। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ফাল্গুনের সোনাঝরা রোদ্দুরে নিজ ভাষায় কথা বলার দাবিতে, মায়ের মুখের ভাষার সম্মান প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে, প্রকাশ্য রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন বাংলার বীরসন্তানরা।

ভাষার প্রশ্নে একুশের আন্দোলন হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে তা ছিল শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রথম সম্মিলিত প্রতিবাদ। রক্তঝরা সে দিনটি তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে আত্ম-অধিকার সচেতন করেছিল। সেখান থেকেই সমতাভিত্তিক সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্নযাত্রা শুরু হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়ার প্রথম দৃষ্টান্ত এটি। মাতৃভাষার জন্য বাঙালির গৌরবময় আন্দোলনের ৬৮ বছর পূর্ণ হচ্ছে শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি)। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউরের রক্তে সিক্ত শোকের দিনটি এখন অহঙ্কার ও গৌরবের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তাই বরাবরের মতো অনন্য আয়োজনে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর তাদের ৩০তম সম্মেলনে ২৮টি দেশের সমর্থনে ফেব্রুয়ারির এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৮৮ দেশে একযোগে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বাঙালি জাতির জন্য এক অনন্যসাধারণ অর্জন। বাঙালি জাতির জন্য দিনটি যেমন চরম শোক ও বেদনার তেমনি মায়ের ভাষা বাংলার অধিকার আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত। যে কোনও জাতির জন্য সবচেয়ে মহৎ ও দুর্লভ উত্তরাধিকার হচ্ছে মৃত্যুর উত্তরাধিকার-মরতে জানা ও মরতে পারার উত্তরাধিকার। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদরা জাতিকে সেমহৎ ও দুর্লভ উত্তরাধিকার দিয়ে গেছেন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ‘বাংলা’কে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র ও যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সে সময়ের শাসকগোষ্ঠির চোখ-রাঙানি ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে। মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দুর্বার গতি পাকিস্তানি শাসকদের শংকিত করে তোলায় সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। তাদের এই আত্মদান নিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সরদার ফজলুল করিম তার ‘বায়ান্নরও আগে’ প্রবন্ধে লিখেছেন,‘‘বরকত, সালামকে আমরা ভালবাসি। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা বরকত সালাম আমাদের ভালবাসে। ওরা আমাদের ভালবাসে বলেই ওদের জীবন দিয়ে আমাদের জীবন রক্ষা করেছে। ওরা আমাদের জীবনে অমৃতরসের স্পর্শ দিয়ে গেছে। সে রসে আমরা জনে জনে, প্রতিজনে এবং সমগ্রজনে সিক্ত।’’তাদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে আমরা অমরতা পেয়েছি উল্লেখ করে সরদার ফজলুল করিম আরও লেখেন, ‘‘আজ আমরা বলতে পারি দস্যুকে, বর্বরকে এবং দাম্ভিককে তোমরা আর আমাদের মারতে পারবে না। কেননা বরকত সালাম রক্তের সমুদ্র মন্থন করে আমাদের জীবনে অমরতার স্পর্শ দিয়ে গেছেন।’’

বরেণ্য শিক্ষাবিদ আবুল ফজল একুশ নিয়ে তার এক লেখায় লিখেছেন, ‘‘মাতৃভাষার দাবি স্বভাবের দাবি। ন্যায়ের দাবি, সত্যের দাবি, এ দাবির লড়াইয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদরা প্রাণ দিয়েছেন। প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন, স্বভাবের ব্যাপারে, ন্যায় ও সত্যের ব্যাপারে কোনও আপস চলে না, চলে না কোন গোঁজামিল। জীবন-মৃত্যুর ভ্রকুটি উপেক্ষা করেই হতে হয় তার সম্মুখীন।’’ ২১ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) সরকারি ছুটির দিন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ সারা দেশের স্থায়ী-অস্থায়ী শত শত মিনারে দিনভর চলবে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন। বিশ্বের দেশে দেশে নানা ভাষা, নানা বর্ণ, নানা সংস্কৃতির মানুষ গাইছে একুশের অমর গানÍ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি।’ মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। 

বাণীতে তারা ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। একই সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের চেতনায় শহীদদের স্বপ্ন পূরণে দেশ ও জাতির কল্যাণে এগিয়ে আসার জন্যও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান তারা। অমর একুশে পালন নিরাপদ রাখতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, আজিমপুর কবরস্থানসহ একুশের প্রভাতফেরি প্রদক্ষিণের এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রণয়ন করা হয়েছে শহীদ মিনারে প্রবেশের রোডম্যাপ। বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাত ৭টা থেকেই এটি কার্যকর হয়েছে। শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) দুপুর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও এর আশপাশের এলাকায় সর্বসাধারণের সুবিধার্থে যানবাহন চলাচলও নিয়ন্ত্রণ থাকবে। শুধু সুনির্দিষ্ট স্টিকারসংবলিত যানবাহন ওই এলাকায় প্রবেশ করতে পারবে। এদিন সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনগুলোয় জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ছাড়াও ২১ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) সকাল ৭টায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং কালো পতাকা উত্তোলন করবে। ২২ ফেব্রুয়ারি (শনিবার) বিকাল ৩টায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আর্ন্তজাতিক সন্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বিএনপি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ছাড়াও ভোর ৬টায় কালো ব্যাজ ধারণ এবং আজিমপুর কবরস্থানে ভাষাশহীদদের কবর জিয়ারত করবে।

কর্মসুচি: মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে খুলনা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয়পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, খুবি, কুয়েট, কৃবি, কেসিসি, বিআইডব্লিউটিএ, খুলনা প্রেসকাবসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতি সংগঠন ব্যাপক কর্মসুচি গ্রহন করেছে।