২০০০ টাকার কাঁকড়া ৩০০ টাকায়

120
Spread the love

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি

কাঁকড়ার খামারচীনে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কাঁকড়া ও কুঁচে চাষিদের ওপর। গত ২৫ জানুয়ারি থেকে চীনে রফতানি হচ্ছে না সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণাঞ্চলের কাঁকড়া ও কুঁচে। ফলে এই দুই রফতানি পণ্য চাষ ও আহরণের সঙ্গে যুক্ত কয়েক হাজার মানুষ বিপাকে পড়েছেন। দেশের বাজারেও কাঁকড়ার দাম অন্তত পাঁচগুণ কমে গেছে। এছাড়া বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা চীনের আমদানিকারকদের কাছে কাঁকড়া ও কুঁচের দাম বাবদ ১৫০ কোটি টাকা পাবেন, তা হাতে না আসায় অনেক ব্যবসায়ী আর্থিক সংকটে পড়েছেন।

সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া বাজারে হেমন্ত এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী হেমন্ত দলুই জানান, ছয় বছর ধরে তিনি পারুলিয়া বাজারে কাঁকড়া ও কুঁচে কেনাবেচা করছেন। কালীগঞ্জ উপজেলার উজিরপুর, দেবহাটার গাজীরজাট, বদরতলা, কুলিয়া পারুলিয়াসহ বিভিন্ন বাজার থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এ বাজারে কুঁচে ও কাঁকড়া বিক্রি করে থাকেন। এ বাজারে তিনি একাই কুঁচে কিনলেও কাঁকড়া কেনেন অনেকে। তিনি জানান, এক সময় প্রাকৃতিকভাবে নদী, খাল, পুকুরসহ বিভিন্ন জলাশয়ে কাঁকড়া ও কুঁচে পাওয়া যেত। সাতক্ষীরায় সাধারণত মিষ্টি পানির কুঁচে ও লোনা পানির কুঁচে পাওয়া যায়। মিষ্টি পানির কুঁচে কেজিপ্রতি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়। আর লোনা পানির কুঁচে বিক্রি হয় কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ১১০ টাকায়। হিন্দু ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ মিষ্টি পানির কুঁচে খান। তখন কম দামেই পাওয়া যেতো এসব কাঁকড়া ও কুঁচে। কয়েক বছর আগে চীনসহ মধ্যপ্রাচের কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের কাঁকড়া ও কুঁচের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে শুরু হয় বাংলাদেশ থেকে ওইসব দেশে কাঁকড়া ও কুঁচে রফতানি।

চাষি ও ব্যবসায়ীরা জানান, কাঁকড়া গ্রেড অনুযায়ী বিক্রি শুরু হয়। কাঁকড়ার আকার ও গুণগত মান অনুযায়ী কেজিপ্রতি চীনে বিক্রি হতো এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার টাকায়। ফলে সাতক্ষীরার মানুষ কাঁকড়া চাষ ও কুঁচে সংগ্রহের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়ে। চীনে রফতানির জন্য তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে দুই তিন দিন পরপর পাঁচ থেকে ছয় টন কুঁচে ঢাকার উত্তরায় পাঠানো হতো। কাঁকড়া ও কুঁচে রফতানি করে বাংলাদেশ সরকার মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতো। তবে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় গত ২৫ জানুয়ারি থেকে চীনে কাঁকড়া ও কুঁচে রফতানি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে খরিদ্দার না থাকায় প্রতিদিন বেশ কিছু কুঁচে মারা যাচ্ছে। মারা যাওয়া কুঁচে শুকিয়ে কাঁকড়া ধরার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ, কলবাড়ি ও বুড়িগোয়ালিনিতে। দক্ষিণ পারুলিয়ার সুনীল ভুঁইয়া বলেন, তিনি ১২ বছর ধরে কুঁচে মজুত করে ঢাকায় পাঠান। তিনিসহ ছয়জন এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। চীনে কুঁচে রফতানি বন্ধ হওয়ার পর বাজার থেকে যে কুঁচে তিনি কিনছেন তার বড় অংশই মারা যাচ্ছে। ফলে তারা আর্থিকভাবে লোকসানে পড়েছেন।

একই গ্রামের মৃণাল ভুঁইয়া বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমি কুঁচে ও কাঁকড়া সংগ্রহ করে পারুলিয়াসহ বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছি। দুই সপ্তাহ ধরে সাতক্ষীরা থেকে কাঁকড়া ও কুঁচে ঢাকা হয়ে চীনে রফতনি বন্ধ আছে। ফলে এখন সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। আগের কাজ বাদ দিয়ে মাঠে ধান রোপণসহ দিনমজুরের কাজ করছি।’

পারুলিয়া বাজারের কাঁকড়া ব্যবসায়ী মনিরুজ্জামান মনু, মিজানুর রহমান ও শাহীনুর ইসলাম জানান, চীনে রফতানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা বকেয়া টাকা ঢাকার মালিকদের কাছ থেকে পাচ্ছেন না। ঘের মালিক ও খুচরা বিক্রেতাদের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে সমস্যায় রয়েছেন তারা। বর্তমানে যে কাঁকড়া কিনছেন তা অনেক হ্যাচারি মালিক কম দামে কিনে মজুত করছেন। সাতক্ষীরা জেলা কাঁকড়া ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব মন্ডল বলেন, ‘ঢাকার উত্তরার তমা এন্টারপ্রাইজ, জ্যোতি এন্টারপ্রাইজ ও জেডএল এন্টারপ্রাইজ, কাশেম ইন্টারন্যাশনাল ও সিরাজ ইন্টারন্যাশনালসহ কয়েকটি কোম্পানিকে আমরা কাঁকড়া ও কুঁচে সরবরাহ করে থাকি। ওইসব কোম্পানি মূলত চীন ও উত্তর কোরিয়ায় মাল পাঠায়। গত ২৫ জানুয়ারি থেকে চীনে কাঁকড়া ও কুঁচে রফতানি বন্ধ হওয়ায় সাতক্ষীরার ব্যবসায়ীদের প্রায় ১০ কোটি টাকা আটকে পড়েছে ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে। অনেকে তাদের দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। মধ্যপ্রাচে মঙ্গলবার মাত্র এক টন কাঁকড়া সাতক্ষীরা থেকে রফতানি করা হয়েছে। তবে এর মূল্য চীনা বাজার থেকে অর্ধেকেরও কম। অবিলম্বে চীনে কাঁকড়া ও কুঁচে রফতানি করা না গেলে এ পেশার সঙ্গে জড়িত সাতক্ষীরার কয়েক হাজার মানুষ কাজ হারিয়ে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়তে পারে।’

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিসার মশিউর রহমান বলেন, ‘গত বছর জেলায় ৩১০ দশমিক ৯ হেক্টর জমিতে কাঁকড়া চাষ হয়। ওই জমি থেকে দুই হাজার ১৯০ দশমিক ৪ মেট্রিক টন ও সুন্দরবন থেকে এক হাজার ১০৯ মেট্রিক টন কাঁকড়া সংগ্রহ করা হয়। তবে কুঁচে কী পরিমাণ সংগ্রহ করা হয়েছিল তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। আপাতত চীনে কাঁকড়া ও কুঁচে রফতানি বন্ধ আছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা চীনের আমদানিকারকদের কাছে ১৫০ কোটি টাকা পাবেন কাঁকড়া ও কুঁচের দাম বাবদ। ফলে একদিকে ব্যবসা বন্ধ, অপরদিকে পাওনা টাকা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দিতে না পেরে বিপাকে পড়েছেন আড়তদাররা। যে কাঁকড়ার দাম ছিল ২০০০ টাকা, সেই কাঁকড়ার দাম এখন ৩০০ টাকা।’ তিনি জানান, সাতক্ষীরায় উৎপাদিত শতকরা ৯০ ভাগ কাঁকড়া রফতানি হয় চীনে। এদিকে সাতক্ষীরার পার্শ্ববর্তী খুলনার পাইকগাছা থেকে প্রকাশ ঘোষ বিধান জানান, চীনে করোনা ভাইরাসের কারণে বাংলাদেশ থেকে কুঁচে ও কাঁকড়া রফতানি বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন পাইকগাছার কয়েক হাজার চাষি ও ব্যবসায়ী। এর ফলে পাইকগাছায় উৎপাদিত কাঁকড়া ও কুঁচে রফতানি বন্ধ হওয়ায় ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কয়েক হাজার পরিবার কষ্টে জীবনযাপন করছে বলে জানিয়েছেন কাঁকড়া ব্যবসায়ীরা। তিনি আরও বলেন, ‘দেশের কুঁচে ও কাঁকড়া রফতানি হয় মূলত চীন, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে। এরমধ্যে ৯০ শতাংশ কুঁচে ও কাঁকড়া রফতানি হয় চীনে। যার সিংহভাগ উৎপাদন হয় সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলায়।’ পাইকগাছা কাঁকড়া ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি দেবব্রত দাশ দেবু বলেন, ‘চীনে কাঁকড়া ও কুঁচে রফতানি না হলে পুঁজি হারিয়ে বেকার হবেন এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার মানুষ। চীন ছাড়া অন্য দেশে কাঁকড়া ও কুঁচে রফতানির বাজার সৃষ্টিতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।’