বায়ুদূষণে টেকাই দায়, বিকার নেই কারও

43
Spread the love

বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা//

ঢাকার বায়ুদূষণ অনেক আগেই অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। বেশ কিছু দিন ধরে বায়ুদূষণে বিশ্বের এক নম্বর অবস্থানে ঢাকা শহর। দিনকে দিন তা জটিল থেকে জটিলতর পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। পরিস্থিতিকে অত্যন্ত সংকটাপন্ন উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইটভাটা, নির্মাণকাজ, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও আবর্জনা পোড়ানো দূষণের অন্যতম কারণ। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে পারে অসংখ্য মানুষ।

বিশ্বের দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় শনিবার বিকালে প্রথম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। সন্ধ্যা ৬টা ৩৪ মিনিটে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) ঢাকার স্কোর ছিল ২১৮। আর তার এক মিনিট আগে ঢাকার স্কোর ছিল ১৮৫। যার অর্থ ঢাকার বাতাসের মানকে খুবই অস্বাস্থ্যকর।

বাংলাদেশে বায়ুদূষণের উৎস নিয়ে গত বছরের মার্চে একটি গবেষণা প্রকাশ করে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্ব ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, দেশে বায়ু দূষণের প্রধান তিনটি উৎস হচ্ছে ইট ভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও নির্মাণ কাজ। গত আট বছর ধরে এই তিন উৎস ক্রমেই বাড়ছে।

২০১৩ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে দেশের ইটভাটাগুলোর ওপর একটি জরিপ করা হয়। যেখানে দেশে ইটভাটার সংখ্যা ৪ হাজার ৯৯৫টি বলে উল্লেখ করা হয়। এরপর ২০১৮ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর পরিচালিত আরেক জরিপে দেখা যায় ইটভাটার সংখ্যা বেড়ে ৭ হাজার ৯০২টি হয়েছে। এরমধ্যে ২ হাজার ৪৮৭ ইটভাটাই ঢাকা বিভাগের মধ্যে গড়ে উঠেছে। ওই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে দেশে মোট যানবাহনের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৬৭৭টি। ২০১৮ সালে তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে ৬ লাখ ১৯ হাজার ৬৫৪টি। চিকিৎসকরা বলছেন, দূষিত বাতাসের কারণে জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন রোগ। বিশেষ করে অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট জনিত রোগের প্রদুর্ভাব অনেক বেড়েছে নগরবাসীর মধ্যে। এতে সবেচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। এমন পরিস্থিতিতে মুক্তির উপায় নিয়ে নানা পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে এ নিয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেছেন।

বায়ুদূষণের উৎস বন্ধ করতে হবে:

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান গনমাধ্যমকে বলেন, রাস্তা-ঘাট খোঁড়াখুড়ি, বিভিন্ন নির্মাণ কাজ শেষের পর বর্জ্যগুলো নিয়ম মাফিক নেয়া হয় না। এরফলে এগুলো বাতাসে মিশে দূষণ হয়। এসব উৎস আামাদের আগে বন্ধ করতে হবে। যদি নিয়ম মাফিক এসব কাজ করা হয়, তবে বায়ু দূষণ অনেকাংশেই কমে যাবে। ‘‘এছাড়াও গাড়ি থেকে যে দূষণ হয় সেটাও রোধ করতে হবে। খারাপ ইঞ্জিনের গাড়ি যেন রাস্তায় চলাচল করতে না পারে; সেটা নিশ্চিত করতে হবে। জ্বালনির বিষয়েও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’’

তিনি বলেন, ‘ঢাকা থেকে ইটের ভাটা কমাতে হবে এবং ইটভাটায় উন্নতমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া সেখানে যে নিম্নমানের কয়লা, রাবার, কাঠ ইত্যাদি পোড়ানো হয়, সেটা বন্ধ করতে হবে। এছাড়াও অন্যান্য কলকারখানার বর্জ্য যেন বায়ুদূষণ করতে না পারে সেটার ব্যাপারেও ব্যবস্থা নিতে হবে।’

বায়ুদূষণে ৫৫ শতাংশ দায়ী ইটভাটা:

শতকরা ৫৫ শতাংশ ইটভাটা বায়ুদূষণের পেছনে দায়ী উল্লেখ করে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু বলেন, ‘ইটভাটার সনাতন পদ্ধতি দ্রুত বন্ধ করতে হবে। ইটভাটাগুলো আধুনিককরণ করা হলে এবং সনাতন পদ্ধতি বন্ধ করা গেলে ঢাকার বায়ুদূষণ অনেকাংশেই কমে আসবে।’

‘‘পাশাপাশি যানবাহনের কালো ধোঁয়া বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। ঢাকার রাস্তায় এখনো আমরা বিশ বছরের বেশি পুরানো যাত্রীবাহী যানবাহন, ট্রাক দেখতে পাই। এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে বায়ুদূষণ কমানো সম্ভব।’’ তিনি আরও বলেন, ‘রাস্তা, বিভিন্ন ইউটিলিটি সার্ভিস ও ভবন নির্মাণ, পুর্ননির্মাণ ও মেরামত কার্যক্রম চলার সময় অস্থায়ী বেষ্টনী দিয়ে নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখতে হবে। ট্রাক বা লরিতে উন্মুক্ত অবস্থায় বালু, মাটি, সিমেন্টসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা, নির্মাণ চলাকালে পর্যাপ্ত পানি ছিটানো হলেও বায়ুদূষণ কম হবে।’ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলাসহ সর্বোপরি বায়ুদূষণের জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলেও জানান এ প্রকৃতিবন্ধু।

রাস্তা পরিস্কারে ভ্যাকুয়াম সুইপিং ট্রাক:

সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ঢাকা ও এর চারপাশের বায়ুদূষণ রোধ এবং তা কমানোর জন্য নীতিমালা প্রণয়নে যে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি, তার সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই সভায় মন্ত্রণালয়ের সচিব জিয়াউল হাসান বলেন, ‘হাতে ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিস্কারের পরিবর্তে ভ্যাকুয়াম সুইপিং ট্রাক ব্যবহার, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কলোনির ময়লা ও বর্জ্য রাস্তায় ফেলানো ও পোড়ানো বন্ধ করা, চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা, ২০০৮ কঠোরভাবে প্রয়োগ করার বিষয়টি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।’

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘ইউটিলিটি সার্ভিসের কাজের জন্য সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। এলিভেটেট এক্সপ্রেস-হাইওয়েসহ বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। সম্প্রতি আমরা ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান বাড়িয়েছি।’ গত ২৯ জানুয়ারি গাজীপুরে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ৪টি ইটভাটা বন্ধ ও ১৫ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর

বায়ুদূষণ রোধে হাইকোর্টের একগুচ্ছ নির্দেশনা:

ঢাকায় পরিবেশ দূষণ রোধে একগুচ্ছ নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। তার মধ্যে-নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি কালো ধোঁয়া ছাড়ানো যানবাহন জব্দ ও ‘ইকোনমিক লাইফ’ পার হয়ে যাওয়া গাড়ি নিষিদ্ধ করতে এক মাসের মধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ, পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া টায়ার পোড়ানো বা ব্যাটারির রি-সাইকিং বন্ধ করা, উন্নয়নকাজের নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে রাখা ইত্যাদি।

এছাড়াও সিটি করপোরেশনের যেসব এলাকায় ধুলোবালি ঠেকাতে পানি ছিটোনো হয়, সেসব এলাকায় নিয়মিত পানি ছিটাতে হবে। একই সঙ্গে আইন ও দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী উন্নয়ন ও নির্মাণকাজ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি দোকান বা মার্কেটে সারা দিনের বর্জ্য ও ময়লা বিন বা ছালায় জমা রাখতে হবে এবং দোকান বা মার্কেট বন্ধ করার সময় মালিকেরা তা সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত জায়গায় ফেলার মতো নির্দেশনাও রয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না।