এশিয়ার সেরা তীরন্দাজ খুলনার রোমান সানা

40
Spread the love

  • সামন হোসেন 

২০০২ সাল। ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে বসেছিল কমনওয়েলথ গেমসের আসর। বরাবরের মতোই আমাদের অ্যাথলেটরা অংশ নিয়েছিলেন শুধুই নিয়ম রক্ষার জন্য। কিন্তু একদিন আসে সুখবর। আসিফ হোসেন খান নামের পাবনার এক তরুণ শ্যুটিংয়ের ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে জেতেন স্বর্ণপদক। আসিফের স্বর্ণ জয়ে চারদিকে হইচই পড়ে যায়। রাতারাতি তারকা বনে যাওয়া আসিফকে নিয়ে দেশ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে অলিম্পিক পদকের। কিন্তু যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাকে অলিম্পিকের জন্য তৈরি করার কথা ছিল তার কিছুই দেয়া হয়নি। উল্টো ২০০৬ সালে অনুশীলনের জন্য স্টেডিয়ামে ঢোকার পথে পুলিশ তাকে মারধর করে, জখম হয় তার হাত দুটো। সুস্থ হয়ে আবার খেলা শুরু করলেও আস্তে আস্তে হারিয়ে যান। এখন খেলা ছেড়ে তিনি কোচিং করছেন বিকেএসপিতে। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো আসিফ হোসেন খান ভারতের শূট্যার যে অভিনব বিন্দ্রাকে হারিয়ে কমনওয়েলথে স্বর্ণ জিতেছিলেন, সেই বিন্দ্রা ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে স্বর্ণ জিতে তার দেশকে গর্বিত করলেও আসিফ হারিয়ে যান কালের অতল গহবরে!

অলিম্পিক বরাবরই আমাদের কাছে স্বপ্নের এক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। খেলাধুলায় আমাদের অংশগ্রহণ, পদক জয় সর্বোচ্চ দক্ষিণ ‘এশিয়ার অলিম্পিক’ হিসেবে খ্যাত সাফ গেমসেই (বর্তমানে এসএ গেমস) সীমাবদ্ধ ছিল। কালের বিবর্তনে ক্রিকেট এখন দেশের এক নাম্বার খেলা। ফুটবলটা মাঝখানে খাদের কিনারায় চলে গেলেও এখন আবার উঠে আসার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে বয়সভিত্তিক নারী ফুটবলে এখন আমাদের মেয়েরা দারুণভাবে উঠে আসছে। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়লেও, বাজেটের আকার ফুলে-ফেঁপে অনেক বড় হলেও পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে খেলাধুলা এখনও আমাদের দেশে বিলাসিতার পর্যায়ে রয়ে গেছে। অলিম্পিক কেন, এসএ গেমসেই আমরা এখন সাত দেশের মধ্যে ৪/৫ নাম্বার পজিশনে থাকি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়াযজ্ঞ, গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ হিসেবে পরিচিত অলিম্পিকে পাশের দেশ ভারত, এমনকি পাকিস্তানও স্বর্ণপদক জিতেছে। কিন্তু আমাদের ৪৮ বছরের ইতিহাসে একটা ব্রোঞ্জও জিততে পারিনি কখনও। পদক জেতা দূরের কথা, এখনও কোনো ইভেন্টে আমরা সরাসরি অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারি না। গত অলিম্পিকে একাধিকবার এশিয়ান ট্যুর জয়ী দেশসেরা গলফার সিদ্দিকুর রহমান সরাসরি অংশগ্রহণ করলেও তেমন ভাল ফল করতে পারেননি। আমরা বরাবরই ওয়াইল্ড কার্ড নামক দয়া বা দাক্ষিণ্যে অলিম্পিক খেলার সুযোগ পাই। তার ওপর একসময় অলিম্পিকে খেলতে গিয়ে আমাদের অ্যাথলেটদের ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার ইতিহাস যোগ করলে অলম্পিক আমাদের জন্য লজ্জা ছাড়া কিছুই বয়ে আনেনি কখনও।

নেদারল্যান্ডসে কিছুদিন আগে বসেছিল আরচারি বিশ্বকাপের আসর। আরচারি নামক তীর-ধনুকের খেলাটির নামও জানেন না আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ। এই আরচারি বিশ্বকাপেই আমাদের তীরন্দাজ মানে আরচার রোমান সানা সেমিফাইনালে খেলেছেন বিশ্বের ৯২টি দেশের ২০০ প্রতিযোগীর সাথে লড়াই করে। সেমিফাইনালে মালয়েশিয়ার খাইরুল আনোয়ারের বিপক্ষে হেরে গেলেও ব্রোঞ্জের লড়াইয়ে বিশ্বের ছয় নাম্বার তারকা ইতালির মাউরো নেসপোলিকে হারিয়ে তৃতীয় স্থান অধিকারের গৌরব অর্জন করেন। সেই সাথে বিশ্ব আরচারিতে জেতেন দেশের প্রথম পদক। যদিও রোমান সানা বিদেশের মাটিতে এর আগে দুটি স্বর্ণপদক জিতেছিলেন।  কিন্তু বিশ্বকাপে পদক জেতার মাহাত্মই তো আলাদা। তাছাড়া বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে তিনি আগামী অলিম্পিকে (টোকিও, ২০২০) সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জনও করে ফেলেছেন। গলফার সিদ্দিকুর রহমানের পর অলিম্পিকে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করা দ্বিতীয় বাংলাদেশি অ্যাথলেট হচ্ছেন রোমান সানা।
এই রোমান সানার কল্যাণেই সদ্য সমাপ্ত এসএ গেমসে আরচারির দশ সোনার দশটিই জিতেছে বাংলাদেশ।  আরচারিরর কারণেই ১৯ সোনা নিয়ে দেশের ফিরেছে এদেশের অ্যাথলেটরা। এর আগে ২০১০ সালে ঘরের মাঠে ১৮টি সোনা জিতেছিল বাংলাদেশ। একক দলগত ও মিশ্র দ্বৈতে সোনা জিতেছেন রোমান। এই রোমানকে নিয়ে এবার স্বপ্ন দেখতেই পারে বাংলাদেশ।

রোমান সানার বেড়ে ওঠা
খুলনার প্রত্যন্ত অঞ্চল সুন্দরবন ঘেঁষা কয়রা উপজেলার বাগালি গ্রামের গুলতিবাজ এক কিশোর সময়ের পরিক্রমায় আজ এশিয়ার সেরা তীরন্দাজ। ফিলিপাইনে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপ স্টেজ থ্রি আর্চারিতে সোনা জিতেছেন তিনি। এশিয়ার সেরা তীরন্দাজ রোমান সানার বাবার নাম মো. আব্দুল গুফুর সানা ও মায়ের নাম বিউটি বেগম। তিন ভাই-বোনের মধ্যে রোমান সবার ছোট। রোমানের বড় ভাই বিপ্লব সানা।

রোমানের উঠে আসার গল্প
ঘটনাটা ২০০৮ সালের। আরচারি ফেডারেশনের প্রতিভা অন্বেষণ ক্যাম্প হয়েছিল খুলনা শহরের পুরোনো স্টেডিয়ামের পাশের সোনালি অতীত ক্লাবের মাঠে। অন্যদের মতো সেদিন খুলনা শিশু উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র রোমানও এসেছিলেন ট্রায়ালে। রোমানের তির ছোড়ার কৌশল আর প্রতিভা কোচ সাজ্জাদ হোসেনকে মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু সেদিন বাছাইয়ে রোমান টিকলেও তাঁর বদলে স্থানীয় আরেকজনকে নিতে চাপ দিয়েছিলেন খুলনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তা এবং ছেলেটির বাবা। সাজ্জাদও নাছোড়বান্দা, ‘আমি বলেছিলাম যদি একটি ছেলেকেও ঢাকায় নিয়ে যাই, সে রোমান।’ এতে কাজ হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত রোমানকেই বেছে নিতে পেরেছিলেন সাজ্জাদ।

ক্যাম্পের শুরুর দিন থেকেই রোমানের ভেতরে ছিল হার না মানার এক অবিচল আঙ্কাক্ষা। ক্যাম্পের শুরুর দিনে একবার ফেডারেশন সাধারণ সম্পাদক কাজী রাজীব উদ্দিন ঘোষণা দেন, যে ছেলে তির ছুঁড়ে সবচেয়ে বেশি স্কোর করতে পারবে, তাকে দেওয়া হবে আর্থিক পুরস্কার। রোমান চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেদিন টাকাটা জিতে নিয়েছিলেন। ২০০৮ সালে প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচিতে খুঁজে পেলেও ফেডারেশন বেশি দিন তাঁকে ধরে রাখতে পারেনি। মাঝে দুই বছর খেলা ছেড়ে খুলনায় চলে গিয়েছিলেন রোমান। একসময় তো মনে হয়েছিল, আর কখনো তির-ধনুক হাতে নেওয়াই হবে না।
২০১২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় রোমান পা হারাতে বসেছিলেন। খুলনায় হাসপাতালে ছিলেন তিন মাস। পাঁচ মাস ছিলেন পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মধ্যে। সেদিনের সেই দুঃস্মৃতির কথা মনে করে রোমান বলছিলেন, ‘আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম আর কখনো খেলতে পারব না। সারাক্ষণ কান্নাকাটি করতাম। মাও কান্নাকাটি করত। তারপরও নিজের ওপর আস্থা হারাইনি।’

বাংলাদেশ আনসারে রোমানকে বেছে নিয়েছিলেন কোচ জিয়াউর রহমান। এই দলের হয়ে ঢাকায় বাংলাদেশ গেমসে যখন তীর হাতে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন রোমান, অনেকেই তাচ্ছিল্যের চোখে তাকিয়েছিল। কিন্তু সেদিন সেরা আরচারদের পেছনে ফেলে রিকার্ভের ব্যক্তিগত ইভেন্টে সোনা জিতে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আমি আসছি।’
এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি রোমানের। ২০১৮ সাল পর্যন্ত জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে জিতেছেন টানা সোনার পদক। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও রোমানের সাফল্য আসছে নিয়মিত। ব্যাংককে এশিয়া কাপ স্টেজ ওয়ানে সোনা জেতেন ২০১৪ সালে। ২০১৭ সালে কিরগিজস্তানে আন্তর্জাতিক আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপেও জেতেন সোনার পদক। ২০১৮ সালে বছর ঢাকায় হওয়া আন্তর্জাতিক সলিডারিটি আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপ এবং বিকেএসপিতে দক্ষিণ এশিয়ান আর্চারিতে জেতেন রুপা। এরপর ২০১৯ সালের ফের্রুয়ারীতে টঙ্গীতে হওয়া সর্বশেষ আন্তর্জাতিক সলিডারিটি আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে জেতেন রুপা। বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে অলিম্পিকে সুযোগ পাওয়ার পরপরই জেতেন ব্রোঞ্জ।

লন্ডন আর বেইজিং অলিম্পিকে খেলা অভিজ্ঞ ইতালির মাওরো নেসপলিকে হারিয়ে বিশ্ব আসরে জেতেন বাংলাদেশের প্রথম পদক। আর এত সব সাফল্যের পেছনের কারিগর অবশ্যই জাতীয় দলের জার্মান কোচ মার্টিন ফ্রেডরিখ।
এবারের এসএ গেমসে রোমানের তিন সোনা জয়ের মধ্য দিয়ে এবারের এসএ গেমসে বাংলাদেশের পদক সংখ্যা হলো ১৯। বিদেশের মাটিতে তো বটেই, দেশ –বিদেশ মিলিয়েই কোন গেমসে এটি বাংলাদেশের সেরা সাফল্য।