ভোটের মাঠ গরম বিদ্রোহীতে

2
Spread the love
  • আসাদুজ্জামান ইমন, ঢাকা


জমে উঠেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের প্রচারণা। আগামী ১ ফেব্রুয়ারি হতে যাচ্ছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। শেষ মুহূর্তের আগে দলীয় মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচারণায় সরব আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তবে নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণার শুরু থেকেই মাঠ গরম করে রেখেছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, দলীয় প্রার্থীর বাইরে দুই সিটির অনেক ওয়ার্ডেই যে বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে তারাই জমিয়ে রেখেছেন নির্বাচনের মাঠ। অনেক ওয়ার্ডেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছেন দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীরাই। কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। তবে এ বিষয়ে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণার শুরুতে দলীয়ভাবে তাদের বসিয়ে দেয়ার কথা বলা হলেও পরে ‘কৌশলগত’ কারণেই তাদের বসানো হয় বলে আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের বাইরে দলীয় যে সকল বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে তাদের বিষয়ে ‘নমনীয়’ অবস্থায় দেখা গেছে দলের হাইকমান্ডকে। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর পদে একক প্রার্থী নিশ্চিত করতে কেন্দ্রের ‘কঠোর নির্দেশ’ ও নানা উদ্যোগের প্রতিফলন নেই ভোটের মাঠে। দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীদের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কঠোর কোনো সিদ্ধান্তের প্রয়োগ দেখাতে পারেনি ক্ষমতাসীন দলটি। তবে এর আগে উপজেলা নির্বাচনেও বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছিল আওয়ামী লীগ।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে অন্তত ১০০ জন সক্রিয় রয়েছেন। প্রচার-প্রচারণার শুরুতে দেখা গেছে- ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩০টিতে বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। তাদের সংখ্যা ৫ থেকে ১০ জন। এগুলো হল- ৪, ৯, ১১, ১২, ১৯, ২৬, ২৮, ৩২, ৩৬, ৩৯, ৪৪, ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৮, ৫০, ৫১, ৫২, ৫৫, ৫৬, ৫৭, ৫৮, ৫৯, ৬০, ৬১, ৬২, ৬৬, ৬৭, ৬৯ ও ৬৪ নম্বর ওয়ার্ড। আর ঢাকা উত্তর সিটির ৫৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৯টিতেও ৫ থেকে ৯ জন করে প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এগুলো হল- ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ১১, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ২০, ২৩, ২৫, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৫, ৩৬, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪৩, ৪৭, ৪৮, ৪৯ ও ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড। বিদ্রোহী প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন সংসদ সদস্যের ছেলেও। প্রথমে তিন শতাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী থাকলেও গত ৯ জানুয়ারি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে অন্তত দুইশ জন প্রার্থিতা স্থগিত করেন। বাকিদের মধ্যে বেশিরভাগই কোনো কেন্দ্রীয় নেতা, না হয় সংসদ সদস্য এবং ঢাকা মহানগর উত্তর ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কোনো কোনো শীর্ষ নেতার প্রশ্রয়েই মাঠে রয়ে গেছেন বলে তৃণমূলের ধারণা।
দলীয় সূত্র বলছে, রাজধানীর দুই সিটিতে বেশিরভাগ ওয়ার্ডে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা সক্রিয়। ঢাকার বিভিন্ন সংসদীয় আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ‘মদদে’ দলের মূল প্রার্থীর বিরুদ্ধে মাঠে বিদ্রোহীরা এখনও রয়েছেন। এতে দলের ভেতরে দ্বন্দ্ব স্পষ্ট আকার ধারণ করছে বলেই অভিযোগ আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের।
ঢাকা-৭ আসনের আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য হাজি মো. সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমও এবার ডিএসসিসির ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে ‘বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী’। এ ওয়ার্ডে একসময় হাজি সেলিম কমিশনার ছিলেন। বাবার ওয়ার্ডে দলের মনোনয়ন না পেয়ে ইরফান ‘বিদ্রোহী’ হওয়ায় নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা ক্ষোভ আছে বলে তারা জানিয়েছেন। কেন্দ্রের নির্দেশে হাজি সেলিম যেখানে দলের একক প্রার্থী নিশ্চিতে কাজ করার কথা, সেখানে তার ছেলে বিদ্রোহী হওয়ায় নানা আলোচনা চলছে নেতাকর্মীদের মধ্যে। এবার ওই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর মোহাম্মদ হাসান তিল্লু। যিনি হাজি সেলিমের ভাগিনা বলে জানা গেছে। এর বাইরে এবারের নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হলে তার বিরুদ্ধে ‘কঠোর সাংগঠনিক’ ব্যবস্থা কী হতে পারে, তাকে একটা নির্দিষ্ট সময়, নাকি আজীবনের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করা হবে- এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শিগগিরই আসবে বলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক সূত্র জানায়।
রোববার (২৬ জানুয়ারি) ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ২৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাসিবুর রহমান মানিকের সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থী হাসিবুদ্দিন রোসির (ঘুড়ি মার্কা) সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এর আগে কাউন্সিলর মানিকের বিরুদ্ধে এক নারী তার সঙ্গে অনৈতিক কর্মের অভিযোগ আনে। যার একটি ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এ সকল বিষয়ে জানতে একাধিকবার হাসিবুর রহমান মানিকের মোবাইলে ফোনে কল দেয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
গত ১৯ জানুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৩৭ নং ওয়ার্ডের বিদ্রোহী সাহাবুদ্দিন জনির সমর্থকদের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুর করেছে ওই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রহমান মিয়াজীর সমর্থকরা। ওই দিন বিকেলে সদরঘাটের সাইকেল মাঠ এলাকায় একটি পিকআপ ভ্যানে করে নির্বাচনি প্রচারণা চালাচ্ছিলেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী শাহাবুদ্দিন জনির সমর্থকরা। এসময় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা হামলা চালায়। যদিও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রহমান মিয়াজী এটা তার ওপর দোষ চাপানোর জন্য করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন এবং বলেছেন, এই অভিযোগ সত্য নয়।
এ দিকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে কোনো সমঝোতায়ই যেতে রাজি হননি বেশ কয়েকজন বিদ্রোহী প্রার্থী। এ নিয়ে তারা সাংগঠনিক শাস্তির বিষয়টিতেও গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তারা কোনো কিছুতেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন না বলেই জানিয়েছিলেন। রাজধানীর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান নাঈম এবার উত্তরের ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী। তিনি নির্বাচনি প্রচারণামূলক একটি সভায় জনসাধারণের সামনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের এক নেতার নাম উল্লেখ করে বলেছেন, আমাকে কেন্দ্রীয় ওই নেতা বলেছে নির্বাচন করতে। এলাকার জনসাধারণ চায় আমি নির্বাচন করি। আমিও কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ করেই স্বতন্ত্র নির্বাচন করছি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিদ্রোহী প্রার্থী ‘ক্যাসিনো সাঈদ’ হিসেবে পরিচিতি ও নানা অভিযোগে অপসারিত কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ। দল থেকে মনোনয়ন না পেয়ে তার বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার পেছনেও এক মন্ত্রীর ‘মদদ’ রয়েছে বলে ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) যুবলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী জানিয়েছেন।
নির্বাচনের মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, শেষ মুহূর্তে এসে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা মাঠে চষে বেড়াচ্ছেন। সময় ঘনিয়ে আসায় দলীয় ও দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণায় নেমেছেন প্রত্যেক প্রার্থীর পক্ষের সমর্থকরাও। তারা প্রত্যেক বাড়িতে গিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে লিফলেট ও হ্যান্ডবিল দিচ্ছেন। এ ছাড়াও গণসংযোগ, মাইকিং, পোস্টার ঝুলানোর পাশাপাশি ভার্চুয়াল প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন দলের প্রার্থীরা। প্রত্যেক প্রার্থী নিজেদের পক্ষে গানে গানে মাতিয়ে তুলেছেন পুরো এলাকা। বিষয়টি সাধারণ মানুষ ও ভোটাররাও মধুর বিরক্তি বলে মনে করছেন। ভোট চাওয়ার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকও। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাইকিং করা অন্যতম অপরিহার্য একটি বিষয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই মাইকিংয়েও কিছুটা ভিন্নতা এসেছে। সাধারণত গানের মাধ্যমে প্রার্থীদের ভোট চাওয়া হয়। এবার তরুণ প্রজন্মের দৃষ্টি কাড়তে বিভিন্ন গান ব্যবহার হচ্ছে নির্বাচনি প্রচারণায়।

জানা গেছে, আগামী ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় ঢাকার দুই সিটিতে মেয়র পদে মোট ১২ জন এবং সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে ১৭২টি পদের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৭৪১ জন প্রার্থী। প্রতিটি ওয়ার্ডে মূল দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাশাপাশি রয়েছে দুই দলেরই বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী। প্রার্থীদের পাশাপাশি দলের শীর্ষ নেতারাও বিভিন্ন আশ্বাস দিচ্ছেন ভোটারদের। দুই সিটিতেই কাউন্সিল প্রার্থীরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে তাদের প্রচরাণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা ভোটারদের বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। নির্বাচিত হলে ব্যায়ামাগার, পাঠাগার, খেলার মাঠ স্থাপন, আধুনিক স্যুয়ারেজ লাইনসহ সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ ও মাদকমুক্ত ওয়ার্ড উপহার দেয়ার আশ্বাসও দিচ্ছেন তারা।