গোলাম মওলা
আগামী ১ এপ্রিল থেকে ব্যবসায়ীরা যেন সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ নিতে পারেন, সে ব্যাপারে এখন থেকেই ব্যাংকগুলোকে প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করতে সরকারের পক্ষ থেকেও নির্দেশনা রয়েছে। তবে চাপিয়ে দেওয়া এই নির্দেশনা ব্যাংকগুলো মানতে নারাজ। কারণ, ব্যাংক কর্মকর্তারা মনে করেন, সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ দিতে গেলে ব্যাংকের মুনাফা কমে যাবে। আর মুনাফা কমে গেলে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতায় বিরূপ প্রভাব পড়বে।

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খেলাপি ঋণ না কমিয়ে সিঙ্গেল ডিজিট তথা ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণের জন্য চাপ দেওয়া হলে এর বড় আঘাতটা আসবে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর। কারণ, এটা করতে ব্যাংকের তহবিল ব্যয় কমানোর প্রয়োজন হবে। প্রসঙ্গত, বর্তমানে ব্যাংক ভেদে উৎপাদন খাতে সুদহার ১১ থেকে ১৪ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সবাই ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন না। ব্যাংকিং খাতে যাদের প্রভাব আছে, কেবল তারাই ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন।’ তিনি উল্লেখ করেন, এটা করতে ব্যাংকের তহবিল ব্যয় কমানোর প্রয়োজন হবে। এতে বড় আঘাতটা আসবে অল্প আয়ের মানুষের ওপর। সীমিত আয়ের সঞ্চয়কারীরা ক্ষতির মুখে পড়বেন।

তিনি বলেন, ‘ঋণে ৯ শতাংশ সুদের কথা বলে আমানতকারীদের কাছ থেকে কম সুদে ডিপোজিট নেওয়া শুরু করলে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আসল কথা হলো—সাধারণ ভোক্তা বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন না। একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে গিয়ে উল্টো এসএমই ও অন্যান্য খাতে ঋণের সুদ হার আরও বাড়তে পারে।’
ব্যাংক খাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা মনে করেন, ৬ শতাংশ সুদে আমানত পেলে ৯ শতাংশে ঋণ বিতরণ করা হবে। তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এসএমই) ঋণ সিঙ্গেল ডিজিটে দেওয়া হয়তো সম্ভব হবে না। গত মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় এসএমই ঋণ সিঙ্গেল ডিজিটের বাইরে রাখার সুপারিশ করেছে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। সভায় ব্যাংকাররা বলেন, ঝুঁকি বেশি হওয়ায় ভোক্তা ঋণ এবং এসএমই খাতে ৯ শতাংশে ঋণ বিতরণ করা সম্ভব নয়। বিষয়টি বিবেচনার জন্য তারা গভর্নরকে অনুরোধ জানিয়েছেন। বৈঠক শেষে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স-বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান আলী রেজা ইফতেখার সাংবাদিকদের বলেন, ‘ব্যাংকার্স সভায় আমরা অনুরোধ করেছি, ভোক্তা এবং এসএমই ঋণ এই ৯ শতাংশ সুদের হার থেকে যেন আমাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়।’ এ সময় তিনি উল্লেখ করেন, ৬ শতাংশে আমানত পেলেই ৯ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা সম্ভব হবে।

অবশ্য সভায় এমডিদের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এমডিরা এসএমই খাতকে সিঙ্গেল ডিজিটের বাইরে রাখার সুপারিশ করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের সেই সুপারিশ সমর্থন করে না। কারণ, দেশের উন্নয়নে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অবদান অস্বীকার করার সুযোগ নেই।’
একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, উৎপাদন খাতে ৯ শতাংশ সুদ বেঁধে দিলে অনেক ব্যাংকের আয় ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত কমে যাবে। তার আশঙ্কা, ৯ শতাংশ সুদ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমানতের সুদও কমিয়ে দিতে হবে। এতে আমানতকারীদের ক্ষতি ছাড়াও ব্যাংকে তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। আর যেসব ব্যাংক সরকারি আমানত পাবে না, তারা ৯ শতাংশ সুদ বাস্তবায়ন করতেই পারবে না।
এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ দিচ্ছে। তবে সব ব্যাংক যদি ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ শুরু করে, তাহলে অর্থনীতিতে এর সুফল মিলবে। যারা শিল্প উদ্যোক্তা তাদের উপকার হবে। দেশের শিল্পায়ন হবে। শিল্পায়ন হলে কর্মসংস্থান হবে। তবে ব্যাংকের লাভ কিছুটা কম হবে।’