ডুবোচর-নাব্য সংকটে ঝুঁকিপূর্ণ নৌপথ

43
Spread the love

খুলনাঞ্চল রির্পোট

অসংখ্য ডুবোচর আর নাব্য সংকটে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে দেশের নৌপথ। নদীতে চলতে থাকা নৌযানের তলা হঠাৎ করেই আটকে যাচ্ছে অদৃশ্য চরে। ঘটছে দুর্ঘটনা। আবার কোথাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা জোয়ারের জন্য অপেক্ষা, কোথাও বিকল্প পথে ঘুরে যেতে হচ্ছে লঞ্চ, কার্গোকে। নৌযান মালিক-শ্রমিকদের অভিযোগ, সঠিকভাবে নৌপথ খনন ও সতর্কীকরণ চিহ্ন স্থাপন না করায় শুষ্ক মৌসুমের শুরু থেকেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

রাজবাড়ীর দেবগ্রাম ইউনিয়নের কাওয়ালজানির কাছে পদ্মা নদীতে গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর বালুবাহী একটি ট্রলার থেকে পড়ে মিরাজ (৪৫) নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে। স্থানীয়রা জানান, ধাওয়াপাড়া থেকে বালু নিয়ে মাদারীপুরের শিবচরে যাচ্ছিল ট্রলারটি। হঠাৎ ডুবোচরের সঙ্গে ট্রলারটির তলা আটকে গেলে তীব্র ঝাঁকুনিতে নদীতে ছিটকে পড়েন মিরাজ। মুহূর্র্তেই নদীর প্রবল স্রোতে হারিয়ে যান তিনি। শুধু কাওয়ালজানির পদ্মাতেই নয়, সারাদেশে অসংখ্য ডুবোচরে ধাক্কা লেগে প্রতিদিনই একাধিক দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানা গেছে।

নিয়ম অনুযায়ী, নৌপথের গভীরতা পরিমাপ করে যথাযথ সতর্কতা চিহ্ন স্থাপন করার দায়িত্ব বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ)। নৌপথ সচল রাখতে প্রয়োজনীয় খননের কাজও তাদের। তবে এ ক্ষেত্রে সংস্থারটি সঠিক ভ‚মিকা পালন করতে পারছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। লঞ্চ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল (যা-প) সংস্থার সচিব সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী জানান, ঢাকা থেকে দেশের ৪১ নৌরুটের মধ্যে ৪০টির সব কটিতেই বর্তমানে ডুবোচর ও নাব্য সংকট দেখা দিয়েছে। শুধু চাঁদপুর রুটটি ঠিক আছে। তিনি বলেন, বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং নিয়ে বরাবরই আমরা অভিযোগ করছি। যদি তারা সময়মতো সঠিকভাবে নৌরুটগুলো খনন করত তবে শুষ্ক মৌসুমে এ অবস্থা হতো না।

নাব্য সংকটের কারণে বরিশালের হিজলার মিয়ার চরের চ্যানেলটি দিয়ে লঞ্চ চলাচল প্রায় বন্ধ রয়েছে অনেক দিন ধরে। প্রায় ১০ কিলোমিটার বেশি ঘুরে ভাষানচর-কালীগঞ্জ হয়ে চলাচল করছে। বরিশাল ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন নদীতে ভাটার সময় লঞ্চ বা নৌযান আটকে পড়ার ঘটনা ঘটছে।

নৌযান শ্রমিকরা জানান, বরিশাল ও পটুয়াখালী নদীবন্দরের আশপাশেই নাব্য সংকট রয়েছে। এ ছাড়া লোহালিয়া, কবাই ও কারখানা নদীর বেশ কয়েকটি চ্যানেল, বরিশাল-ভোলা নৌপথের লাহারহাট-ভেদুরিয়া ফেরিঘাট এলাকায়, বরগুনার খাকদন, বিষখালীসহ বিভিন্ন নদীর পয়েন্টে পলি জমে নৌপথের গভীরতা কমে এসেছে। এসব পথে নৌযান চালাতে হিমশিম খেতে হয় মাস্টার, ড্রাইভারদের। নাব্য সংকট ও ডুবোচরের কারণে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াই হাজারসহ অনেক রুটে ফেরি চলাচল প্রায় ব্যাহত হচ্ছে।

এমভি সুন্দরবন-১১ লঞ্চের মাস্টার আলমগীর হোসেন বলেন, বরিশাল নদীবন্দর থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত অন্তত ৫টি পয়েন্ট বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ কারণে বিআইডব্লিউটিএ’র নির্ধারিত চ্যানেল মেঘনার উলানিয়া-কালীগঞ্জ হয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। কিন্তু এ চ্যানেলেও নাব্য সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে অনেক সময় লঞ্চগুলোকে ভোলার ইলিশা হয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। এতে গন্তব্যে পৌঁছতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় ও তিন ব্যারেল তেল বেশি লাগছে।

পাথর, বালু ও কয়লা পরিবহনের জন্য দেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ ছাতক, ভোলাগঞ্জ, সুনামগঞ্জও চরমভাবে নাব্য সংকটে পড়েছে। অসংখ্য ডুবোচরও আছে এসব পথে। বাংলাদেশ কার্গো ট্রলার বাল্কহেড শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহজাহান হাওলাদার জানান, সুনামগঞ্জ থেকে নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ির সাঁওতাল এলাকায় নৌপথের অবস্থা ভয়াবহ। যেখানে পণ্যবাহী এসব জাহাজ চলার জন্য ১২ ফুট গভীরতা প্রয়োজন, সেখানে এখন তা ৭ ফুটে দাঁড়িয়েছে। নদীর চারভাগের একভাগে এখন শুধু পানি আছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিদিন প্রায় ২০০ জাহাজ এ পথে চলাচল করে। কিন্তু খুব সতর্কতার সঙ্গে চালালেও মাঝে মধ্যেই অনেক জাহাজের তলা আটকে যায়। ফলে পণ্য নামিয়ে ও জোয়ারের সময় পানি বাড়লে আটকে পড়া জাহাজগুলোকে উদ্ধার করতে হয়।

এদিকে নৌপথে সঠিকভাবে সতর্কতা চিহ্ন স্থাপন না করায় ঝুঁকি বাড়ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক লঞ্চ মালিক জানান, বিআইডব্লিউটিএর চিহ্ন স্থাপনের অবস্থা এতই খারাপ যে, সেগুলো দেখে রাতে লঞ্চ চালানো যায় না। আমাদের মাস্টার, সারেংরা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই লঞ্চ চালিয়ে থাকেন। কিন্তু নদীতে লুকিয়ে থাকা ডুবোচর তো আর তারা দেখতে পান না। তিনি বলেন, বিআইডব্লিউটিএর হাইড্রোগ্রাফি বিভাগ পানির গভীরতা জরিপ করে এবং অন্য একটি বিভাগ সেখানে চিহ্ন, বয়া, বিকন বাতি ইত্যাদি স্থাপন করে থাকে। কিন্তু সেটি ঠিকমতো হচ্ছে না বলে মনে হয়।

এসব প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিএর সচিব আবু জাফর হাওলাদার জানান, শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি কমে যাওয়ায় নৌপথের নাব্যও কমে যায়। এ সময় পলি পড়ার হারও বাড়ে। এ কারণে নৌপথগুলো সচল রাখতে নিয়মিত ড্রেজিং করা হয়। প্রয়োজনীয় সতর্ক চিহ্ন স্থাপন করাও বিআইডব্লিউটিএর নিয়মিত কাজ। এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়মের অভিযোগ তার জানা নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।

নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা নেভাল আর্কিটেক্ট এম আবদুল্লাহর মতে, উজানে পানি কমে আসায় প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে এমন সংকট দেখা দেয়া খুব অস্বাভাবিক নয়। তবে নৌপথ ও নৌযানে আধুনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকটা কমে আসবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে এখন অনেক বড় বড় লঞ্চ ও পণ্যবাহী জাহাজ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সব রুটে এসব নৌযান চলাচলের মতো পানি সারা বছর থাকে না। তাই নদী খনন করে রুট তৈরি করতে হয়। খনন করা রুট সাধারণত সরু হয়ে থাকে। নৌযানে যদি জিপিএস, ইকোসাউন্ডারসহ আধুনিক কিছু সিস্টেম থাকে, তবে সরু পথেও সেটি সহজেই চলতে পারবে। এমনকি ঘন কুয়াশাতেও। উন্নত সিগন্যালিং ব্যবস্থায় কিছু সেন্সর যুক্ত থাকে, যা জাহাজটি চর বা তীরের কাছে এলেই সংকেত পাঠিয়ে সতর্ক করে। তাই আমাদেরকেও সেভাবে আধুনিকায়নের দিকে যেতে হবে।